Thursday, February 06, 2025

সমাধান

মূলঃ ক্ল্যারিস লিসপেক্টর
ইংরেজি অনুবাদ: ক্যাটরিনা ডডসন



তার নাম ছিল আলমিরা, মেয়েটা অনেক মোটা হয়ে গিয়েছিল। এলিস ছিল তার সব থেকে প্রিয় বন্ধু। অন্তত সবাইকে সে দুঃখ করে এই কথাই বলতো। অন্য মেয়েটির পক্ষ থেকে বন্ধুত্বের অভাব ছিল, তার নিজের তরফের প্রচণ্ডতাই যথেষ্ট সেটুকু পূরণ করে দিতে সক্ষম এই রকম কোনো একটা ইচ্ছা থেকে।

এলিস তার কথা না শুনে অন্য দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে টাইপ করছিল।

এলিসের পক্ষ থেকে বন্ধুত্ব যত অস্তিত্বহীন হচ্ছিল, আলমিরার পক্ষ থেকে তা ততই গাঢ় হচ্ছিল। এলিসের মুখটা গোলগাল, মখমলের মতন। আলমিরার নাক সবসময় চকচক করতো। আলমিরার চোখেমুখে সবসময় একটা উদগ্রতা থাকত যেটা সে কখনোই লুকানোর চেষ্টা করতো না: খাবারের ক্ষেত্রেও তার একই মনোভাব ছিল, পৃথিবীর সাথে তার সবচেয়ে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ।

এলিস কেন আলমিরার সাথে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখেছিল, তা কেউ ব্যাখ্যা করতে পারতো না। দুইজনেই টাইপিস্ট এবং সহকর্মী ছিল, কিন্তু সেটা এই ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট নয়। দুইজন একসাথে দুপুরের খাবার খেত, এই ব্যাখ্যাও যথেষ্ট নয়। দুইজনে একই সময়ে অফিস থেকে বের হতো এবং একই লাইনে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতো। আলমিরা সবসময় এলিসের খেয়াল রাখতো। আর এলিস একটু দূরত্ব বজায় রাখতো, একটু উদাস, সবাই তাকে ভালবাসবে এই আকাঙ্ক্ষায়। এলিস ছিল ছোটোখাটো ও কোমল। আলমিরার মুখটা বেশ চওড়া, পাণ্ডুবর্ণ আর উজ্জ্বল: তার লিপস্টিক কখনোই ঠিক থাকতো না, সে ঐ ধরনের ছিল যারা না বুঝে লিপস্টিক খেয়ে ফেলত।

“আমার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রেডিও প্রোগ্রামটা দারুণ লেগেছে,” আলমিরা এরকম কিছু একটা বলে এলিসকে প্রসন্ন করার চেষ্টা করতো। আর এলিস এই সব তার প্রাপ্যই মনে করতো, এই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অপেরাসমেত সবকিছু।

আসলে আলমিরা প্রকৃতি ছিল কোমল, ঐ মস্ত গোল দেহটা সমেত। একটা বাজে কথা বলে ফেললে সেটার জন্য অনুতপ্ত হয়ে সারা রাত নির্ঘুম পার করে দিতে পারতো। কিছু একটা অন্যায় করেছে এই রকম ধারণা হবার সাথে সাথে তার মুখের সুস্বাদু চকোলেটের টুকরাটাও তার বিস্বাদ লাগতো। তার ব্যাগে সব সময় চকোলেট থাকতো, আরেকটা জিনিসের অভাব ছিল না, সেটা হলো কখন কী খারাপ করে ফেলে তার জন্য সতর্ক ভাবনা। সে যে দয়ালু এমন না, সম্ভবত দুর্বল দেহে দুর্বল স্নায়ুর ফল।

যেদিন সকালে ঘটনাটি ঘটে, আলমিরা অফিসে কাজের জন্য তাড়াহুড়া করে বেড়িয়ে গিয়েছিল একটা রুটি চিবোতে চিবোতে। অফিসে পৌঁছে সে এলিসের ডেস্কের দিকে তাকিয়ে দেখল এলিস তখনো আসেনি। এক ঘণ্টা পরে এলিস আসলো রক্তিম লাল চোখ নিয়ে। সে আলমিরার প্রশ্নের উত্তর দিতে বা ব্যখ্যা করতে চাইছিল না। আলমিরা তার টাইপরাইটারের উপর ঝুঁকে বাস্তবিকই কান্না করে দিচ্ছিল।

শেষমেশ দুপুরের খাবারের সময়। সে এলিসকে খুব করে অনুরোধ করলো তার সাথে খাবার জন্য, সে খাওয়াবে।



ঠিক দুপুরের খাবারের সময়ই ঘটনাটা ঘটেছিল।

আলমিরা কী ঘটেছিল তা জানার জন্য ব্যাকুল হচ্ছিল। কেনইবা এলিসের অফিস আসতে দেরি হলো, কেনইবা তার চোখগুলো ওরকম রক্তলাল। নিরুৎসাহী এলিস খুব একটা উত্তর করছিল না। আলমিরা খুব উদগ্র হয়ে খাচ্ছিল আর কী হয়েছে তা জানার জন্য চাপাচাপি করতে থাকলো, চোখ জলে ভরা, ছলছল।

“ধুরু মুটকি!” ক্রোধে নীরক্ত এলিস, “তুই আমাকে একটু মাফ করতে পারিস না?”

আলমিরার গলায় খাবার আটকে গেল, কথা বলার চেষ্টা করলো, তোতালাতে থাকলো। এলিসের নম্র মুখ নিঃসৃত বাক্যাবলি আলমিরা জি ডে আলমেইডার খাবারের সাথে মিলে গলা দিয়ে আর নামছিল না।

“তুই একটা আপদ, একটা অনধিকারচর্চাকারী।” এলিস আবার ফেটে পড়লো। “তুই জানতে চাস কী হয়েছে তাই না? ঠিক আছে, আমি তোকে বলছি। কীট কোথাকার: জেকুইনহা পোর্তো আলেগ্রেতে চলে গেছে, আর কখনো ফিরবে না। খুশি হইছিস মুটকি?”

আসলেই যেন এই শেষ কিছু মুহূর্তে আলমিরা আরেকটু ফুলে গিয়েছিল, তখনো তার মুখ ভর্তি খাবার।

ঠিক তক্ষুনি যেন আলমিরা ঐ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করলো। এবং একটা পাতলা মেয়ের মতন, কাঁটাচামচটা হাতে নিল, এবং এলিসের ঘাড়ে বসিয়ে দিল। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, রেস্টুরেন্টের সবাই এক সাথে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিছু মোটা মেয়েটা, ঐ ঘটনার পরেও শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে বসে ছিল, অন্য মেয়েটার রক্তের দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি।

এলিসকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওখান থেকে ব্যান্ডেজ নিয়ে ছাড়া পেলো, চোখমুখে তখনো ভয়ের কাঁপন। আলমিরাকে ঘটনাস্থলের গ্রেপ্তার করা হয়।

কিছু প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে তাদের বন্ধুত্বের মধ্যে সবসময়ই কোথায় যেন একটা সমস্যা ছিল। পরিবারের বন্ধুগোত্রীয় যারা, তাদের মনে পড়লো আলমিরার দাদির কথা, ডোনা আলতামিরান্দা কেমন অদ্ভুত নারী ছিলেন। কারোরই এটা মনে হলো না যে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মোটা মোটা পাগুলো থাকা সত্ত্বেও হাতি খুবই সংবেদনশীল প্রাণী।

জেলের ভিতর আলমিরা ছিল খুবই অনুগত এবং উৎসাহী, সম্ভবত একাকীত্ববোধে আক্রান্ত, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই প্রসন্নচিত্ত। সে তার সাথের সবাইকে সাহায্য করতো। শেষমেশ তার বন্ধু হলো। সে কাপড় ধোয়ার দায়িত্বে ছিল। গার্ডদের সাথেও ভালো সম্পর্ক হলো, তারা মাঝে মাঝেই ওকে চকোলেট বার দিতো। ঠিক সার্কাসের হাতির মতো।

Wednesday, February 05, 2025

এখানে রমণীগুলি নদীর মতন বা নিগ্রোর নদী কথন

মূলঃ ল্যাংস্টন হিউজেস















তবে আমি নদীগুলিকে চিনি
পৃথিবীর মতন পুরাতন সব নদী
মানুষের শিরায় শিরায় বয়ে যাওয়া শোণিতধারার চেয়েও পুরাতন

নদীর মতন গভীর আত্মা বয়ে নিয়ে চলেছি

সেই তরুণ বেলায় ফোরাতের জলে নেমেছিলাম
তারপর কঙ্গোপাড়ের কুড়েতে দুদণ্ডে ঘুম এনে দিয়েছিলো
নীলের ভাটিতে গড়েছি পিরামিড,
শুনেছি মিসিসিপির গান, লিংকনের পদধ্বনি
নিউ অরলিয়েন্সের দিকে
তার পলিমাখা বুকে দেখেছি সোনালি সূর্যাস্ত

নদীরে চিনেছি আমি
পুরাতন, অন্ধকার নদী সব

আমার ভেতরটা নদীর গভীর খাতের মতন













Friday, January 24, 2025

সেলিম মোরশেদ এর কান্নাঘর














“কান্নাঘর”কে সেলিম মোরশেদের গল্প বা ফিকশন হিসেবেই পড়ি আমরা। একশন ধর্মী ফিকশন বলা যায়। একশনটা তৈরী হতে থাকে কর্তাভজা ভগবেনে সম্প্রদায় ও তার গুরু বিজয়মোহনকে ঘিরে। একটা একশন দৃশ্যের জন্য প্রয়োজনীয় রূপকল্প তৈরি হতে থাকে। একশন মানে একেবারে মারামারিই, তাও আবার আগ্নেয়াস্ত্র, রক্তারক্তি ব্যাপার আছে। বাস্তবে যেমন থাকে। কিন্তু ভগবেনেদের নিষেধ আছে। অমান্য করলে জরিমানা হয়।

গল্পের বর্ণনায় শুরুতে আমরা একটা নতুন পরিবেশকে চিনতে শুরু করি এই একটা প্রামান্যচিত্রের মতন করে। বেগুন, আলুর স্তুপ, গামলায়, এরপরে আবার বেগুন আলুর স্তুপ, গুরু বাড়ির এই সেবা আয়োজনের ভেতরে আমরা ঢুকে পড়ি এই পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে। এরপরে আরো একবার “প্রথম প্রহরে চিড়ে, টক দই ...”। গুরু বিজয় মোহন এর চোখের জলের মতই ঝরতে থাকে। এরপর সাংবাদিকরা, অতিথিরা চলে গেলে আমরাও বিজয় ঠাকুরের ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারি। তার দুই চোখের জলের হদিস পাই।

“তরকারিতে যেমন গুরু মসলা নেই।” তেমনি সহজ জীবন, সহজিয়া ধর্ম, সহজ প্রশ্ন নিয়েই মানুষের কারবার। বাইরের মানুষের কাছে সেগুলি হয়ত সহজ হয়ে ধরা দেয় না। তাই এক জায়গায় পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মানুষগুলিকে নিত্যানন্দ-সদানন্দ-বিজয়-যশোদা-আসমা-মাধুরী-মিল্লাত-দুই সাংবাদিক-ছটাকে মোশারফ-দেড় ব্যাটারি-শহীদ ড্রাইভার...। এই স্বল্প পরিসরেও প্রত্যেকটি চরিত্র স্ব স্ব ভূমিকা পালন করতে থাকে।

জলজ সন্তরণ, কান্নার জলে। সেই জলের তলে কী আছে? জলজ উদ্ভিদ, শেওলা, জলের মধ্যে মাছও আছে। সে মাছ সদা চঞ্চল। জীবনের কী সাধ্য তার দর্শন স্থির করে। এই জল থেকে উঁকি মেরে শ্বাস নেয়, আবার ডুব দেয় জীবনের জন্য। নাকি উল্টোটা। বাস্তবের সংঘাতে জলের ঘোর কিছুক্ষণের জন্যে কেটে যায়, সেখানেই গল্পের ক্লাইম্যাক্স। হয়ত এর পরে এখান থেকেই নতুন জলের আখ্যান, নতুন কান্নাঘরের উদ্বোধন হবে। আমরা সেই আশায় থাকি।



শ্রীচৈতন্য দেবের বৈষ্ণব আন্দোলন এক দিকে যেমন ভাবান্দোলনের সূচনা করেছিল, আরেকদিকে সামাজিক বিপ্লবেরও সূচনা করেছিল। এই গৌরচাঁদের বিদায়ের সাথে সাথেই তার উত্তরাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এক দিকে উচ্চ বৃন্দাবনবাদীরা, অপর দিকে নিত্যানন্দের অনুসারী দল। চৈতন্যদেবের জীবদ্দশাতেই শুধু যে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও বেদবর্জিত শুদ্র শ্রেনী হরিনামের ছোঁয়া পাচ্ছিল তা নয়, সহজিয়ারা বা তান্ত্রিকপন্থাও এই সামাজিক বিপ্লবে ব্রাহ্মণ্যবাদকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার যোগাড় করছিল। সেটা কতটুকু কী পরিমাণে সে বিবেচনা করা যাবে তুলাদন্ডে অন্য অবসরে। তবে চৈতন্য দেবের অন্তর্ধানের পর বৃন্দাবনবাদী অদ্বৈতাচার্যের প্রভাবে, রূপ-সনাতন প্রভৃতি গোস্বামীদের দ্বারা জরুরী ভিত্তিতে প্রচুর শাস্ত্র লিখিত হয়। বেদবর্জিতরা হয়ে ওঠেন শাস্ত্রবর্জিত। অন্যদিকে নিত্যানন্দের পুত্র বীরচন্দ্র বা বীরভদ্র হয়ে ওঠেন সহজিয়া বৈষ্ণবদের অবতার।


বীরচন্দ্ররূপে পুনঃ গৌরঅবতার
যে না দেখেছে গৌর সে দেখুক আবার


তারই প্রশ্রয়ে-আশ্রয়ে সহজিয়া-তান্ত্রিকেরা বৈষ্ণববাদের ছায়াতলে আসে, থেকে যায়। এই সহজিয়াদেরই এক শাখা গল্পের ভগবেনে সম্প্রদায়। গল্পের মধ্যেই আমরা দেখি, বিজয় মোহন কালের হিসেব ফেঁদেছেন, ঠিক ক্লাইম্যাক্সের আগে দিয়ে, গোরাচাঁদ থেকে আউলচাঁদ। আউলচাঁদ থেকেই কর্তাভজারা। ভক্ত ও গুরু, গুরু ও ভক্ত, গুরুভক্ত মিলে কালের আবর্তনে গড়িয়ে চলে, গুরু ছাড়া ভক্ত হয় না, ভক্ত ছাড়া গুরু হয় না।


ভক্ত আমার মাতাপিতা
ভক্ত আমার গুরু
ভক্তরে রেখেছে নাম বাঞ্ছা কল্পতরু।


বিজয়মোহন রোমন্থন করছেন, যুগান্তরের সেই প্রবাহকেই, সেই মহাবীর থেকে বুদ্ধ, রামানন্দ হয়ে কবীর, তার থেকে চৈতন্য, চৈতন্য হতে আউলচাঁদ। বিজয়মোহন নিজেকে এই যুগাবতারদের ধারাতেই আবিষ্কার করছেন। কিন্তু আবিষ্কার করেই আঁতকে উঠছেন নিজেকে মূল্যায়ণ করতে গিয়ে। এখানে দুর্বল বিজয়মোহনকে আবিষ্কার করি আমরা। যুগ-প্রশ্নের সমাধানে যে গুরু ব্যর্থ হতে যাচ্ছেন, এমন আলামত পাই।


কান্নাঘরের ক্লাইম্যাক্সও কিন্তু এই ধারাতেই পাওয়া যাচ্ছে। বিজয়মোহনের পরে কে? তার ডান আর বাম চোখে দুই ধারা, তার অনুজ সদানন্দ ও নিত্যানন্দ। যুগের প্রশ্ন সমাধানে বা জিজ্ঞাসায় কি বিজয়মোহন ব্যর্থ হচ্ছেন? তন্ত্র মন্ত্র এসে কি সহজ মানুষের চোখের জল ঘোলাটে করে দিয়ে যাচ্ছে? গুরু কে? গুরু ব্যর্থ হন কীভাবে? গুরুর তৈয়ার নিয়ম নীতি জীবনপথ এগুলির দ্বারা সংসার চলতে থাকলে চিরন্তন ভাবে, চোখের জলের ধারার মতন, তাহলে আর বাঁধা কোথায়? বাধা আসবেই। বাঁধা আসে স্বাভাবিকভাবে, বাস্তবের বিবর্তনে, আর জলের বাধন তাতে টুটবেই, তাহলে ডানে নাকি বায়ে, কোন দিকে যেতে হবে? জলজ কান্না নাকি শুষ্ক কান্না। সেলিম মোরশেদের এই গল্পটির ঢং টা প্রামান্য ধরণের। সমাধানটা ক্লাইম্যাক্সে স্পষ্ট করে গেছেন। যেন গোটা ভগবেনে সম্প্রদায় দাঁড়িয়ে আছে, ছিল এই যুগসন্ধিক্ষনে, এই সমাধানের অপেক্ষায় আর লেখক আমাদেরকে নিয়ে দাড় করিয়েছেন বিজয়মোহনের উঠোনে, তার কান্নাঘরের সামনে।



গল্পের বর্ণনা প্রামাণ্যধর্মী। পথ দেখিয়ে সাংবাদিক ও অন্যান্য অতিথিদের নিয়ে যাওয়া হয় উঠোনের সামিয়ানার নিচে। ভক্তরাও আছেন, কিন্তু নেপথ্যে, সচল-সজীব বাঞ্ছা-কল্পতরু হয়ে। এক ও অনেকের মধ্যে থেকে লেখক বের করে আনেন সামিয়ানার তল থেকে, নিয়ে যান স্কুলের পাশের চায়ের দোকানে। ছটাকে মোশাররফ আর দেড় ব্যাটারিকে হাজির করেন, এন্টি ম্যাটার। আবার ফিরিয়ে নিয়ে যান উঠোনে। আমরা পাঠকেরা অপেক্ষা করতে থাকি, উঠোনে কখন এন্টি ম্যাটার এসে হাজির হয় তার ক্লাইম্যাক্স নিয়ে।

বিজয়মোহনের কান্নাঘর, ভক্তদের নিয়ে তার সংসার, সে সংসারের আইন। সহজ প্রশ্নে, সহজ মানুষের সহজিয়া তরিকা। আসলেই কি সহজ! এই কান্নার মধ্যেই অতীত, আর ভবিতব্যের ধারা বহমান। সদানন্দের কান্না যেখানে মিলে যায়। সদানন্দ সেই কান্নার আর্দ্রধারা। বিজয়মোহন যাকে উত্তরসুরি হিসেবে মনে মনে নির্বাচন করে রেখেছেন। সেলিম মোরশেদ কিন্তু সদানন্দের স্বরূপের সন্ধান দিয়েছেন। জলজ উদ্ভিদ, সন্তরণশীল মাছের মুখগহ্বরে আসা যাওয়া করে প্রতিক্ষণ, কান্নার জল যতক্ষণ তাকে ধারণ করে, এর বাইরেও, বাস্তবেও। প্রশ্ন জাগে এই মীন সন্তরণে কাদা হয় না? জল ঘোলা হয়ে যায় না তখন?


আর শুষ্ক ধারাটির নাম নিত্যানন্দ। সেও কান্নার অংশ। কিন্তু বাস্তবতা তাকে প্রকাশ্যে কাঁদতে দেয় না। আড়াল খুজতে সে শহরে যায়, হোটেলে গিয়ে ওঠে, কিন্তু তবুও কাঁদার অবকাশ পায় না। ফিরে আসে বাস্তব থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে। ভগবেনে প্রান্তিক সম্প্রদায়। তাদের বিশ্বাস সহজিয়া দর্শনের মতন সহজিয়া জীবন ধারণ প্রক্রিয়ার ফলে তাদের রোগবালাই হয় না। এমনই অনেক আইন রয়ে গেছে কর্তাভজাদের সংসারে। আছে বিধিনিষেধ, চুরি, এঁটো, ছেনালি, মদ, মাংস, মিথ্যা ও রক্তারক্তি। বৈদ্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে না, রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে না। বাস্তব ধর্মগুলির আইন যেমন হয় আর কি! সে আইন অমান্য করলে আছে জরিমানা, পাপ-পূন্য এবং তার অধিক হিসাবের ধারাপাত। প্রত্যাখ্যাত নিত্যানন্দ সেখানেও সহজ প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করে। এ জন্যেই বোধহয় অশ্রুহীন কাঁদতে হয় তাকে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর না মিলিয়ে সে কাঁদতে পারে না। সেও প্রতি মুহুর্তে কম্পমান সেই জলজ শৈবালের মতনই। কান্নাঘরের সেও এক অনিবার্য অশ্রু।


কান্নাঘরের সংকটটিকে সেলিম মোরশেদ একটা আপাত সমাধানের দিকে নিয়ে যান বলে মনে হতে পারে। ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে খেয়াল করি, ভক্তরা তাকিয়ে আছেন, গুরুবদল এর পালা শুরু হচ্ছে। পাঠকের জায়গা থেকে দেখলে আমরাও এই পরিণতিকামী সমাধানের দিকেই যেতে চাই। কিন্তু ভগবেনে সম্প্রদায়টির ভাগ্যে কি ঘটে আমরা আর জানতে পারি না। প্রান্তিক ভক্তগুরু সম্প্রদায়ের ফিকশন ফেলে আমরা আমাদের নন ফিকশন জীবনের বাস্তবতায় ফিরি, কান্নাঘর গল্পটির অবসানে। কিন্তু কান্না চলতে থাকে।





Sunday, January 12, 2025

অপসারী





১৭ই জুলাই, সকাল


আজকে আশুরা। ক্যাম্পের ওদিকে গেলে হয়ত আরও ভালোভাবে টের পাওয়া যেত। এইবারও কি অন্যবারের মতো আশুরার মিছিল হবে? সকালের নাস্তা করতে একটু দেরি হলো। রুটি আর ডিম ভাঁজি। কালশি রোডের এই ফ্ল্যাটটা একটু বড়।কিচেনটা ঠিকঠাক। ফিল্টার মেশিন থেকে গ্লাসে পানি নিতে নিতে রাকিবুল এর চিন্তা এলো বাসায় ফোন দিতে হবে। ছুটির দিনগুলিতে বাসায় সবাইকে এক সাথে পাওয়া যাবে। 


"হ্যালো, তোমরা কেমন আছো?"

"নাস্তা করছি।"

 

কথা বলতে বলতে ওয়াশিং মেশিন টা চালিয়ে দিল। এই বাসায় আম্মা-আব্বাকে আনা যাবে। ঝিনাইদাতে বড় ভাই থাকাতে অবশ্য আরাম পান, কিন্তু ঢাকায় এলে আম্মার চিকিৎসার ভালো সুবিধা হতো। 


"আম্মা ওষুধ খাইছেন?"

"অফিসে যাই কেমনে? কেন বাইকে করে।"

"তাড়াতাড়ি কি অফিস থেকে আসা যায় আম্মা? না আম্মা।"

"কী যে বলেন আম্মা! কাজ থাকে না?"   

"আচ্ছা চেষ্টা করবো।"

"রাফসান কি করে?" 


রাফসান ইকবালের ছেলে। রাকিবুলের বড় ভাই ইকবাল। ঝিনাইদায় সোনালি ব্যাংকে চাকরি করে। ঢাকার বাসাটা অনেকখানি গুছিয়ে এনেছে রাকিবুল। আব্বা বিমান বাহিনী থেকে রিটায়ার করার পর থেকে ঝিনাইদাতেই থাকেন।


"না আব্বা, আমি কোনো মিটিং-মিছিলে যাই না।"

"না না, আমাদের ওখানে তেমন কিছু নেই।"

"কথা হইছে এমআইএসটির জুনিয়রদের সাথে, অত ঝামেলা হয় নি।"     

"হ্যাঁ বলবো পিয়াসকে।"


পিয়াস রাকিবুলের বন্ধু। ওকেও একটা ফোন দেয়া যায়, আজকে দেখা করা যায় একটু। মোটর সাইকেলটার সাইলেন্সারটাও ঠিক করতে হবে। ওর পরিচিত একটা গ্যারেজ আছে বলেছিল, দশ নম্বরের দিকে।



১৯ শে জুলাই, সন্ধ্যা


গতকাল থেকেই মন ভালো নেই হাফিজা খাতুনের। গতকাল সারাদিন বাড্ডা আর বনশ্রীতে দারুণ গোলাগুলি। সন্ধ্যায় দশ নম্বরে নাকি আগুন দিয়েছে, কাজিপাড়াতেও, পুলিশ সারাদিন গোলাগুলি করেছে, হেলিকপ্টার থেকে নাকি গুলি করছে। এগুলি কেমন ধরণের কথা! কালকে রাত থেকে ইন্টারনেট নেই, ফোনের নেটওয়ার্ক ভালো না। কতগুলি মানুষ মারা গেলো কে জানে।জুমার পর থেকে নাকি আরও বেড়েছে গোলমাল।ছেলেটাকে ফোন দেয়া দরকার। 


"হ্যালো, তুমি কোথায়?"

"বাসা থেকে বের হইয়ো না।" 

"ঢাকার অবস্থা কেমন?"

"তোমার আব্বার সাথে কথা বলবা?"



হাফিজা খাতুনের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক। বিমান বাহিনীতে ওয়ারেন্ট অফিসার ছিলেন। দুই ছেলে। ইকবাল ব্যাংকার। ছোটটা ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী আছেন, নাতি আছে। নাতি এসেছে চাচার সাথে কথা বলতে। 


"ছোট বাবা, ছোট বাবা।" 

"তুমি চলে আসো।"

"মোটর সাইকেল করে চলে আসবা।"

"গাড়ী চলে না?" 

"তাহলে এম্বুলেন্সে করে চলে আসবা।"


আবু বকর বুঝতে পারছেন ঢাকার অবস্থা ভালো না। মঙ্গলবারে রংপুরে বেগম রোকেয়ার একটা ছেলে মারা গেলো। সারা দেশে আরও কতজন। পরের দিন ছুটি বলে রক্ষা ছিল। ভেবেছিলেন বৃহস্পতিবার থেকে হয়ত আন্দোলন একটু কমে যাবে। মনে হচ্ছে এইবার বেশ সময় লাগবে সব ঠাণ্ডা হতে। রাতে কারফিউ দেয়ার সম্ভাবনা আছে। 


কিছু ক্ষণ পর। 


ছেলের কাছে ঢাকার অবস্থা ভালো নেই শোনার পর থেকে হাফিজা খাতুনের প্রাণটা ছটফট করছিল। ছেলে কোনো রাজনীতি বা অন্য কোনোকিছুর সাথে নেই। দুই ছেলেই এখন প্রায় প্রতিষ্ঠিত। বড়টা ব্যাংকে। ছোটোটা ইঞ্জিনিয়ার। একটা চাকরি পেয়েছে। বিসিএস এর জন্য পড়ছে। বড় ফ্ল্যাট নিয়েছে। হাফিজা খাতুন কিছুতেই আশ্বস্ত হন না। স্বামীর কাছ থেকে আবার ফোনটা নিলেন।


"এই রাতে গ্যারেজে কেন?"

"দশ নম্বরে কি করো?" 

"তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরত যাও।"

"রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।"

"হ্যাঁ সাড়ে নয়টার মধ্যেই।" 

"তোমার আব্বা এশার নামাজ পইড়া আবার ফোন দিবেন।"  


বিয়েটা করিয়ে ফেলতে হবে। হাফিজা খাতুন বুঝে পান না ছেলে কি তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বললো কিনা যে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু উনি জানেন, ছেলে খুব শান্ত স্বভাবের।কোটা আন্দোলনের কোনো মিছিলে-মিটিং এ যায় না। তবু মন মানে না। কী একটা বাজতে থাকে মনের মধ্যে। এমন না তো, যে ছেলে আন্দোলনে যায়। আর মিছিল থেকে দূরে এসে এসে আমাদেরকে ফোন করে যাতে আমরা টের না পাই? আঠারো তারিখে মুগ্ধ নামের একটা ছেলে মারা গেছে, বিইউপিতে পড়তো, রাকিবদের এমআইএসটির পাশেই তো। ফ্রিজটা খোলেন হাফিজা খাতুন। নারকেল, গুড়, পুলি পিঠার পুরের সরঞ্জাম। রাকিবের পছন্দের। নাতিটা কি করছে দেখতে যান। 



২০ শে জুলাই, সকাল


"জ্বি, পিয়াস ভাই।"

"দুপুরের মধ্যে ঝিনাইদা পৌঁছে যাব।"

"কারফিউ কেমন ঢাকায়?"

"না সমস্যা হয় নাই। সালমানরে ঠিকানাটা পাঠাইছেন। হ্যাঁ, ইকবাল ভাই এর সাথে কথা হইছে।"

"উনার আম্মা বার বার সেনস হারাই ফেলতেছেন।"

"ঠিক আছে ভাই, আপডেট জানাতে থাকবো।"


ফয়সাল। রাকিবের সহকর্মী। এম্বুলেন্সে, সাথে সালমান, আরেক সহকর্মী। এম্বুলেন্সে রাকিবের লাশ। গত রাতে ১১ টার দিকে রাকিবের ফোন থেকে হাফিজা খাতুনের কাছে আরেকটা ফোন গিয়েছিল। কথা বলেছিল পিয়াস, মৃত্যু  সংবাদ জানাতে। একজন মহিলা রাস্তা পার হয়ে রাকিবুলের সামনে এসে পড়ে যায়, রাকিবুল মহিলাকে তুলতে গেলেই গুলিটা লাগে এসে। 


পিয়াসই লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। সালমানের মোবাইল থেকে ঠিকানাটা পড়লো ফয়সাল। মহিষাকুণ্ডু, সার্কিট হাউজ রোড, ঝিনাইদা। 



২৮ শে জুলাই, কোনো এক সময়    


"জ্বি আমি ইকবাল"

"দাফন করা হয়েছে ২০ তারিখ দুপুরে, পারিবারিক কবরস্থানে।"

"আমাদের গ্রামের বাড়ি। গ্রাম বাসুদেবপুর, হরিণাকুন্ডু উপজেলা।" 


ইকবাল, রাকিবুলের ভাই। একজন সাংবাদিক ফোন করেছেন। বেশ কয়েকটা পত্রিকার সাংবাদিক কথা বলেছেন। একটু ভয়ে ভয়েই আছেন সবাই। ভাই যে আন্দোলন এ ছিল না, সে কথা প্রশাসনকে বোঝাবে কে! এখনো পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেনি অবশ্য। 


"১৯ তারিখ রাতে।"

"মিরপুর ১০ আর ১১ মেট্রো স্টেশনের মাঝের এলাকায়।"


ইকবাল সেদিন একটা কথা হয়ত বলেন নি সাংবাদিকদেরকে। বা সাংবাদিকেরাও হয়ত তখন লিখেন নি।  


"আমার ভাই আন্দোলনে ছিল, আমরা বুঝতে পারি নি।"



*****


তথ্যসূত্র: প্রথম আলো

প্রকাশের তারিখ: ২৮ জুলাই, ২০২৪

ভার্সন: অনলাইন (https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/r58r8gagqm) 


*****


#RememberingOurHeroes

#JulyMassacre










Saturday, October 19, 2024

এ আবার কোন পাখি

ইগো 

আমার একজন প্রেমিক ছিল, খাওয়ার সময় নিজেকে দেখতে দিত না। চাইতো না আমি দেখি, ও কীভাবে চিবোচ্ছে, গিলছে,  গব গব করে খাচ্ছে বা পান করছে এবং দাঁতের ফাঁক থেকে মাংস চুষে বের করছে। 

সে চাইত না আমি তাকে সঙ্কটাবস্থায় দেখে ফেলি। 


পুরোনো "আমি" দেরকে 

সব পুড়ে ফেলো
আগে যা যা বলেছ, যত বাণী-ভবিষ্যৎবাণী, আদেশ উপদেশ সব 
লাগলে সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম করো

অভিযোগ করো না
অন্যের ঘটমানতার মধ্যে নিজের নৌকা ভাসিয়ো না
গলায় অন্যের কথা  
দাওয়াতে গিয়ে নাক নিচু করে ফালতু হাসাহাসি বাদ দাও:  
আহ এদের বাচ্চাকাচ্চা যদি কিছু কম হতো!

সংশোধন আবশ্যিক,
ফুল ফোটার মতন প্রয়োজনীয়
তুমি যখন এক হাতে স্ফটিক আরেক হাতে প্রতিশোধ নিয়ে এসে হাজির হও, তখন মনে রেখো একটা মেঠো আবাবিল যখন বসন্তে ফেরত আসে, দাগওলা পালকগুলি বাদ দিলে সেও এক নতুন পাখি।


তুমি অন্য মেয়েদের মতো নও

না, ওইরকম মায়া-মায়া ভাব নিয়ে নয়, তোমার শীতল কণ্ঠে, যেন তুমি চিন্তিত নও, সে ফোন করবে কি করবে না, তাতে তোমার কিছু আসে যায় না, আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলো,  এর চেয়ে কত ভালোদের সাথে যেতে পারো। তুমি সেই মিষ্টি ধাঁধার মতো, স্বপ্নময়ী, তবে বোতলের ঢাকনা আঁটা। তোমার কোথাও কোনো দুর্বলতার আভাস নেই।

না, তুমি অন্য মেয়েদের মতো নও, সে বলে, স্মিতমুখে। তুমি যা যা ফেলে এসেছো, সে ওগুলিরই প্রশংসা করে।


টুয়েন্টিস

প্রথম পাঁকা চুল খুঁজে পাই ঊনিশে, প্রথম কোন ছেলের সাথে শুয়েছি একুশে।মাসের পর মাস শুধু শিম আর কটন বল খেয়ে থেকেছি। বছরের পর বছর পার করেছি হাই তুলে। একটা লম্বামতন লাল জামা পরে রাস্তায় তোমার সাথে নেচেছিলাম, সেই রাতের তারুণ্য আর কখনো ফিরে পাবো না। অনেক কিছু মনে নেই, আর কিছু জিনিস কখনো পাল্টায় না। প্রথমত, প্রথম সিগারেট আর দ্বিতীয়ত শরীরের রোমাঞ্চ। একবার জেরুজালেমে একটা মেয়েকে চুমু খেয়েছিলাম,  ফিনফিনে একটা মেয়ে, চেরির মতন লাল ঠোঁট, তার ফোন নাম্বার রাখি নি। তাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরার জন্য এত কাতর হবো, এটা বুঝতে পারি নি। 

 
কলেজ বয়

তুমি এনেছিলে মদ, আর একটু হেসে বলেছিলে, আমি সব থেকে সুন্দর মেয়ে। আমি মদ গিলছিলাম আর তুমি দেখছিলে (তুমি অপেক্ষা করছিলে),  আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল, যেন একটা মসৃণ গর্তের দিকে আগাচ্ছি, তুমি খুঁড়বে বলে। 

(তুমি কী জানো, হরিণ শিকার আইনত দণ্ডনীয়, কিন্তু কোনো মেয়েকে মাতাল করাকে ডেটিং বলে)

আমার রুমমেট দেখেছিল, তুমি আমাকে বয়ে আনলে, সিঁড়ির কার্পেটের উপর দিয়ে হাঁটতে পারছিলাম না, ঘুমাচ্ছিলাম। 

(আমি যদি তাই চেয়ে থাকি?) 

সকালে তুমি জিজ্ঞেস করলে, আমি ঘুমাচ্ছিলাম কিনা। যেন আমার শরীরটাকে শুধু পোশাকই ধরে রেখেছিল, আমি যেন কখনো জেগে ছিলাম না।  



 কেট বেয়ার  



অনুবাদকের নোটঃ একটা সোভিয়েত গল্প আছে "এ আবার কোন পাখি" শিরোনামের, শিশুতোষ। আপাত পুরুষ হয়ে ইন্সটাগ্রামের নারী কবির অনুবাদ করা মুশকিল আছে। আমার প্রেমিকার সাথে প্রথম প্রথম আমি মাঝে মাঝে ইগো সংকটে ভুগতাম, পরে উনি আমার স্ত্রী হয়ে এসে ইগো সংকটকে রূপান্তরিত করে ফেলেছিলেন। 



Thursday, October 17, 2024

জাকারিয়া মোহাম্মদ এর ফেসবুক কবিতা

পরিযায়ী সারস
আমি তোমার কথা বলি
শুভ্র অলসতায় পতিত জমিতে...
এই সব নিয়ে আমার কবিতা।
আর ঘরের কাঠঠোকরাটি,
তার মাথার ছোট ঝুটি,
চাষের জমিতে দানা কুড়ানো,
তার কথাও বলি।
এমনই অবস্থা আমার, কবিতা সংশয়ী
এক পা বুনেছি পতিত জমিতে
আরেক খানা চাষের লাঙ্গল,
এই অক্ত গৃহবাসী মুকিমের তো
আর অক্তে দোয়া মুসাফির।



১৬ই আগস্ট, ২০১৩
জাকারিয়া মোহাম্মদ
রামাল্লা, প্যালেস্টাইন




Sunday, April 07, 2024

পশ্চিমের ''ফার্স্ট কাউ"

 ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২১ 





কলম্বিয়া নদীতে একটা জাহাজ চলছে, সেই দৃশ্য দিয়ে সিনেমার শুরু। পর্দার বাম থেকে জাহজটা তার স্বাভাবিক গতি নিয়ে পর্দার ডান পর্যন্ত যায়। জাহাজের ইঞ্জিন অতি আধুনিক, আকার প্রকান্ড। একই নদী আমরা যদি দুশ বা আড়াইশ বছর পেছনে গিয়ে দেখি, দেখবো আরেকটা জাহাজ। এটিও বাম থেকে ডানে ধীর গতিতে পার করবে, এই ইঞ্জিন আরেকটু ধীর হতে পারে। জীবনের অতি স্বাভাবিক গতিকে অতিক্রম করার উপায় নেই। ফিকশন, সিনেমায়, গল্পে, উপন্যাসে এমনকি বাস্তবে, কোন ইঞ্জিনই জীবনকে দ্রুতগামী করতে পারে না। ফার্স্ট কাউ সিনেমার প্রথম কয়েকটি দৃশ্য।




আমেরিকার উত্তরের ওরেগনের একটি ট্রেডিং পোস্ট এই সিনেমার গল্পের কেন্দ্রে। ট্রেডিং পোস্ট মানে সেই পুরানো দিনে, আমেরিকার পশ্চিম তখনো ইউরোপীয় সেটেলাররা পুরোপুরি দখলে আনতে পারে নি । যখন জীবন ধীর ছিল বললে আমরা আর আপত্তি করি না। ইউরোপে তখন পুঁজির ঢেউ লেগেছে, নতুন পৃথিবীর পশ্চিম বাকী পৃথিবীর মানুষেরা জয় করতে এসেছে। কোষে কোষে এখনো প্রাক-কৃষি যুগের ডিএনএ। সিনেমার মূল চরিত্র ফিগোউইতজ ওরফে কুকি প্রাক-কৃষি যুগের সংগ্রাহক গোছের, এই নতুন দুনিয়াতে রান্না ও রুটি ইত্যাদি বেকারী সামগ্রীর তৈয়ারে পারঙ্গম। বীভার শিকারী একটা দলের খোরাক যোগানোর কাজে নিযুক্ত হয়ে সেই দলের সাথে আমেরিকার পশ্চিম তীরের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্যারিসে তখন বীভারের চামড়ার হ্যাটের ফ্যাশন পড়ন্ত। নতুন ফ্যাশন কী হবে সেই দুর্ভাবনা করতে দেখি হাজার মাইল দূরের নেটিভ আমেরিকার সর্দারকে। কে বলে জীবন ধীরগতির!





জঙ্গলে মাশরুম খুঁজতে গিয়ে কুকি ফিগোউইতজ এর সাথে দেখা হয় চৈনিক কিং লুর। কিংলু ডায়াস্পোরা, ম্যারিল্যান্ডের কুকিও এক অর্থে ডায়াস্পোরা। ইউরোপীয়, চৈনিক, নিগ্রো, নেটিভ, ইহুদী, মুসলমান, ইন্ডিয়ান, আরব, গরীব, দুঃখী, ডায়াস্পোরা ইত্যাদি। কিংলু কুকির চেয়েও ভালো ইংরেজি বলে, অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান ও কুশলী, ক্যাপিটালিজম এর স্বপ্ন তার দুইচোখে, সান ফ্রান্সিসকোতে গিয়ে নতুন হোটেল খুলতে চায়। ক্যান্টন থেকে জাহাজে চড়ে লন্ডন ঘুরে ওরেগন পৌছেছে এই ডায়াস্পোরা। রাশিয়ান রা তার পিছু নিয়েছিলো। কুকি তার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। ফার্স্ট কাউ বন্ধুত্বের গল্প।





এই বাণিজ্য কেন্দ্রটিতে আমরা অনেক জাতের মানুষকে দেখতে পাই যারা সংগ্রামে লিপ্ত, জীবনের প্রত্যেকটি দিন ধীর গতিতে আগাচ্ছে, একটা দিনের পরে আরেক দিন টিকে থাকাই জটিল ও কঠিন। ডিরেক্টর চিত্রনাট্যের শৈল্পিক ধীরতায় পটভূমির মধ্যে নিয়ে আসেন কলম্বিয়া নদীর ধার, অরণ্য, কুটির, বাজার, বাজারের প্রাঙ্গনের কাঁদা, মানুষের অনিশ্চিত সংগ্রাম, তার মধ্যে ক্ষমতা ও সভ্যতার দ্বন্দ্ব। ঔপনিবেশিক চিফ এই ক্ষমতার পিরামিডের উপরে বসে আছেন, বাকীরা প্রায় নাই বললেই হয়। ওরেগনের এই আদিম কাঁদার পৃথিবীতে তার ক্ষমতা তাকেই শুধু লন্ডন (যা কিনা ততকালীন বিশ্বের তথাকথিত সভ্যতার উৎকর্ষের কেন্দ্র) এর আরাম আয়েশের কথা ভাবার সুযোগ দেয়। তার ইচ্ছে হয়, ইংলিশ চা পানের, লিকারের সাথে কিঞ্চিৎ গোদুগ্ধ। এর ফলেই সিনেমার হাজির হয় কেন্দ্রীয় আরেক প্রধান চরিত্র, গরু! প্রথম গরু, ফার্স্ট কাউ।




কলম্বিয়া নদী ধরে একটা ভেলা বা ফেরীতে করে এক দিন হাজির হয় গরুটা। পথে তার স্বামী ও সন্তানের মৃত্যু ঘটেছে। এই দুগ্ধবতীকে কেন্দ্র করেই এর পর আগাতে থাকে মানুষের আগ্রহ, সিনেমার গল্প।




ছোট বাণিজ্য কেন্দ্রটিতে পরিবর্তন আসছে। গরু চলে আসা একটা লক্ষণ। সেই গরু ঘাসের গালিচায় বাধা থাকে। তাকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত হয় শ্রমিক। কুকি রান্নায় পারদর্শী। একদিন কিংলুর মাথায় বুদ্ধি আসে, গরুর দুধ চুরি করার। চুরি করা অল্প দুধে কুকি বানায় বিস্কুট। সেই সুস্বাদু বিস্কুট খেয়ে কিংলু ব্যাবসার বুদ্ধি আটে।




এখানে এক পেগ হুইস্কির দাম দুই সিলভার। অত্র এলাকার মানুষ বহু বহু দিনের গরুর দুধের স্বাদ কী জানে না। কিছু মধু, দারুচিনি, ইত্যাদি সংগ্রহ করে কুকি আর কিংলু প্রথম দিন তৈরি করে ছয়টা তেলের পিঠা। বাজারে গিয়ে বসে যায় সেই ছয়টা পিঠা নিয়ে। বুদ্ধিমান কিংলুর কারণে বেশ ভালো দাম পায় সবকিছুর। উৎসাহিত হয়ে তাদের দুধ চুরি এবং তেলের পিঠা কার্যক্রম চলতে থাকে। কিংলু খুব বুদ্ধি করে যোগান সীমাবদ্ধ রেখে তেলের পিঠার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক লাভ হয়ে যায় অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই। ক্যালিফোর্নিয়াতে তখন অঢেল সুযোগ। অল্প টাকায় জমি পাওয়া যায়। দুই বন্ধু স্বপ্ন দেখতে শুরু করে কৃষি খামারের। প্রাক-কৃষি মানবের ধমনীতে পুঁজির আনন্দ।




রাতের বেলা কুকি প্রতিদিন যায় দুধ চুরি করতে। গাছে উঠে কিংলু পাহারা দেয়। আমাদের প্রাক-কৃষি মানব কুকি, প্রতিদিন গরুর কাছ থেকে অনুমতি নেয়, তার স্বামী ও সন্তানের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। গরু সম্ভবত সেই প্রথম দিকের প্রাণীগুলির একটা যারা মানুষের সাথে কৃষি যুগে প্রবেশ করেছিল। কুকির কথা যেন বুঝতে পারে গরুটা। লেজ নাড়ায়, মাথা নেড়ে সায় দেয়। এক সাথে পুঁজিবাদের সংগ্রামে সাথী হয়।




সুস্বাদু তেলের পিঠা খুব দ্রুতই মনোযোগ কাড়ে চিফের। চিফ কুকিকে ব্যাক্তিগত কাজে লাগায়। তার এক অতিথির জন্য ব্লুবেরি ক্ল্যাফোটিস বানানোর কাজ দেয়। কুকির রান্নায় খুব খুশি হয়ে চিফ তাকে গরু দেখাতে নিয়ে যায়। কুকিকে দেখে গরুটা স্বাভাবিকভাবেই লেজ নাড়ায়, মাথা এগিয়ে দেয় আদরের সাথে। চীফ ও অন্যান্যরা সন্দেহের চোখে দেখে, কিংলু ও কুকি প্রমাদ গোনে। এ যাত্রা বেঁচে যায় দুইজনেই। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে তো!




গল্পের এই জায়গা থেকে আমরা কোন পরিণতির দিকে যেতে চাই ঠিক করে নিতে পারি, বা চাইলে সিনেমাটাও দেখা যেতে পারে গল্পের খাতিরে। পাশেই কলম্বিয়া নদী, কুকি আর কিংলু চাইলে নদীর ভাটিতে পালাতে পারে, অন্যদিকে চিফের আছে বন্দুকবাজ বাহিনী। এই ঔপনিবেশিক ও পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার ন্যায়-অন্যায় সব চীফের পক্ষে। চৈনিক কিংলুর এর মতন এলিয়েন (জেনোফোবিক আমেরিকায়/পৃথিবীতে) আর কুকির মতন দুর্বল-পুঁজিহীন-অর্বাচিন যে অন্যায় করেছে দুধ সংগ্রহ করে তার কী শাস্তি বিধান করা যায়? দুইশ বছর পরের এই পৃথিবীতে কি গল্পটা ভিন্ন হবে? বা আজ থেকে দুইশ বছর পরে আমাদের কবর খুড়ে যারা আমাদের অস্থি-কঙ্কাল আবিষ্কার করবে তারা আমাদের ন্যায়-অন্যায়ের জন্য কি শাস্তি বিধান করবে? সেই নতুন পৃথিবীতে প্রাক-কৃষি মানব, গুহামানবের অধিকার থাকবে তো?




জোনাথন রেমন্ডের গল্পে পরিচালক কেলী রাইকার্ডের সিনেমা ফার্স্ট কাউ। সিনেমাটির শৈল্পিক ধীরগতির কথা বলেছি, কিন্তু এই ধীরগতি নিয়েই ক্লাইম্যাক্স এর দিকে নিয়ে যায় চিত্রনাট্য, থ্রিলার বলা যায় প্রায়। সেই ঊনবিংশ শতকের শুরুর আমেরিকার ওয়েস্ট তার জীবন ও মানুষ, তার দৈনন্দিন ভাবনা, বেঁচে থাকা, বন্ধুত্ব, ইত্যাদি নিয়ে এই ছবি। পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিবে। কত পুরানো? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য বর্তমানের উত্তর-ঔপনিবেশিক / নিও লিবারেল মানুষের অবসর প্রয়োজন।