Sunday, January 12, 2025

অপসারী

১৭ই জুলাই, সকাল


আজকে আশুরা। ক্যাম্পের ওদিকে গেলে হয়ত আরও ভালোভাবে টের পাওয়া যেত। এইবারও কি অন্যবারের মতো আশুরার মিছিল হবে? সকালের নাস্তা করতে একটু দেরি হলো। রুটি আর ডিম ভাঁজি। কালশি রোডের এই ফ্ল্যাটটা একটু বড়।কিচেনটা ঠিকঠাক। ফিল্টার মেশিন থেকে গ্লাসে পানি নিতে নিতে রাকিবুল এর চিন্তা এলো বাসায় ফোন দিতে হবে। ছুটির দিনগুলিতে বাসায় সবাইকে এক সাথে পাওয়া যাবে। 


"হ্যালো, তোমরা কেমন আছো?"

"নাস্তা করছি।"

 

কথা বলতে বলতে ওয়াশিং মেশিন টা চালিয়ে দিল। এই বাসায় আম্মা-আব্বাকে আনা যাবে। ঝিনাইদাতে বড় ভাই থাকাতে অবশ্য আরাম পান, কিন্তু ঢাকায় এলে আম্মার চিকিৎসার ভালো সুবিধা হতো। 


"আম্মা ওষুধ খাইছেন?"

"অফিসে যাই কেমনে? কেন বাইকে করে।"

"তাড়াতাড়ি কি অফিস থেকে আসা যায় আম্মা? না আম্মা।"

"কী যে বলেন আম্মা! কাজ থাকে না?"   

"আচ্ছা চেষ্টা করবো।"

"রাফসান কি করে?" 


রাফসান ইকবালের ছেলে। রাকিবুলের বড় ভাই ইকবাল। ঝিনাইদায় সোনালি ব্যাংকে চাকরি করে। ঢাকার বাসাটা অনেকখানি গুছিয়ে এনেছে রাকিবুল। আব্বা বিমান বাহিনী থেকে রিটায়ার করার পর থেকে ঝিনাইদাতেই থাকেন।


"না আব্বা, আমি কোনো মিটিং-মিছিলে যাই না।"

"না না, আমাদের ওখানে তেমন কিছু নেই।"

"কথা হইছে এমআইএসটির জুনিয়রদের সাথে, অত ঝামেলা হয় নি।"     

"হ্যাঁ বলবো পিয়াসকে।"


পিয়াস রাকিবুলের বন্ধু। ওকেও একটা ফোন দেয়া যায়, আজকে দেখা করা যায় একটু। মোটর সাইকেলটার সাইলেন্সারটাও ঠিক করতে হবে। ওর পরিচিত একটা গ্যারেজ আছে বলেছিল, দশ নম্বরের দিকে।



১৯ শে জুলাই, সন্ধ্যা


গতকাল থেকেই মন ভালো নেই হাফিজা খাতুনের। গতকাল সারাদিন বাড্ডা আর বনশ্রীতে দারুণ গোলাগুলি। সন্ধ্যায় দশ নম্বরে নাকি আগুন দিয়েছে, কাজিপাড়াতেও, পুলিশ সারাদিন গোলাগুলি করেছে, হেলিকপ্টার থেকে নাকি গুলি করছে। এগুলি কেমন ধরণের কথা! কালকে রাত থেকে ইন্টারনেট নেই, ফোনের নেটওয়ার্ক ভালো না। কতগুলি মানুষ মারা গেলো কে জানে।জুমার পর থেকে নাকি আরও বেড়েছে গোলমাল।ছেলেটাকে ফোন দেয়া দরকার। 


"হ্যালো, তুমি কোথায়?"

"বাসা থেকে বের হইয়ো না।" 

"ঢাকার অবস্থা কেমন?"

"তোমার আব্বার সাথে কথা বলবা?"



হাফিজা খাতুনের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক। বিমান বাহিনীতে ওয়ারেন্ট অফিসার ছিলেন। দুই ছেলে। ইকবাল ব্যাংকার। ছোটটা ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী আছেন, নাতি আছে। নাতি এসেছে চাচার সাথে কথা বলতে। 


"ছোট বাবা, ছোট বাবা।" 

"তুমি চলে আসো।"

"মোটর সাইকেল করে চলে আসবা।"

"গাড়ী চলে না?" 

"তাহলে এম্বুলেন্সে করে চলে আসবা।"


আবু বকর বুঝতে পারছেন ঢাকার অবস্থা ভালো না। মঙ্গলবারে রংপুরে বেগম রোকেয়ার একটা ছেলে মারা গেলো। সারা দেশে আরও কতজন। পরের দিন ছুটি বলে রক্ষা ছিল। ভেবেছিলেন বৃহস্পতিবার থেকে হয়ত আন্দোলন একটু কমে যাবে। মনে হচ্ছে এইবার বেশ সময় লাগবে সব ঠাণ্ডা হতে। রাতে কারফিউ দেয়ার সম্ভাবনা আছে। 


কিছু ক্ষণ পর। 


ছেলের কাছে ঢাকার অবস্থা ভালো নেই শোনার পর থেকে হাফিজা খাতুনের প্রাণটা ছটফট করছিল। ছেলে কোনো রাজনীতি বা অন্য কোনোকিছুর সাথে নেই। দুই ছেলেই এখন প্রায় প্রতিষ্ঠিত। বড়টা ব্যাংকে। ছোটোটা ইঞ্জিনিয়ার। একটা চাকরি পেয়েছে। বিসিএস এর জন্য পড়ছে। বড় ফ্ল্যাট নিয়েছে। হাফিজা খাতুন কিছুতেই আশ্বস্ত হন না। স্বামীর কাছ থেকে আবার ফোনটা নিলেন।


"এই রাতে গ্যারেজে কেন?"

"দশ নম্বরে কি করো?" 

"তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরত যাও।"

"রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।"

"হ্যাঁ সাড়ে নয়টার মধ্যেই।" 

"তোমার আব্বা এশার নামাজ পইড়া আবার ফোন দিবেন।"  


বিয়েটা করিয়ে ফেলতে হবে। হাফিজা খাতুন বুঝে পান না ছেলে কি তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বললো কিনা যে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু উনি জানেন, ছেলে খুব শান্ত স্বভাবের।কোটা আন্দোলনের কোনো মিছিলে-মিটিং এ যায় না। তবু মন মানে না। কী একটা বাজতে থাকে মনের মধ্যে। এমন না তো, যে ছেলে আন্দোলনে যায়। আর মিছিল থেকে দূরে এসে এসে আমাদেরকে ফোন করে যাতে আমরা টের না পাই? আঠারো তারিখে মুগ্ধ নামের একটা ছেলে মারা গেছে, বিইউপিতে পড়তো, রাকিবদের এমআইএসটির পাশেই তো। ফ্রিজটা খোলেন হাফিজা খাতুন। নারকেল, গুড়, পুলি পিঠার পুরের সরঞ্জাম। রাকিবের পছন্দের। নাতিটা কি করছে দেখতে যান। 



২০ শে জুলাই, সকাল


"জ্বি, পিয়াস ভাই।"

"দুপুরের মধ্যে ঝিনাইদা পৌঁছে যাব।"

"কারফিউ কেমন ঢাকায়?"

"না সমস্যা হয় নাই। সালমানরে ঠিকানাটা পাঠাইছেন। হ্যাঁ, ইকবাল ভাই এর সাথে কথা হইছে।"

"উনার আম্মা বার বার সেনস হারাই ফেলতেছেন।"

"ঠিক আছে ভাই, আপডেট জানাতে থাকবো।"


ফয়সাল। রাকিবের সহকর্মী। এম্বুলেন্সে, সাথে সালমান, আরেক সহকর্মী। এম্বুলেন্সে রাকিবের লাশ। গত রাতে ১১ টার দিকে রাকিবের ফোন থেকে হাফিজা খাতুনের কাছে আরেকটা ফোন গিয়েছিল। কথা বলেছিল পিয়াস, মৃত্যু  সংবাদ জানাতে। একজন মহিলা রাস্তা পার হয়ে রাকিবুলের সামনে এসে পড়ে যায়, রাকিবুল মহিলাকে তুলতে গেলেই গুলিটা লাগে এসে। 


পিয়াসই লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। সালমানের মোবাইল থেকে ঠিকানাটা পড়লো ফয়সাল। মহিষাকুণ্ডু, সার্কিট হাউজ রোড, ঝিনাইদা। 



২৮ শে জুলাই, কোনো এক সময়    


"জ্বি আমি ইকবাল"

"দাফন করা হয়েছে ২০ তারিখ দুপুরে, পারিবারিক কবরস্থানে।"

"আমাদের গ্রামের বাড়ি। গ্রাম বাসুদেবপুর, হরিণাকুন্ডু উপজেলা।" 


ইকবাল, রাকিবুলের ভাই। একজন সাংবাদিক ফোন করেছেন। বেশ কয়েকটা পত্রিকার সাংবাদিক কথা বলেছেন। একটু ভয়ে ভয়েই আছেন সবাই। ভাই যে আন্দোলন এ ছিল না, সে কথা প্রশাসনকে বোঝাবে কে! এখনো পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেনি অবশ্য। 


"১৯ তারিখ রাতে।"

"মিরপুর ১০ আর ১১ মেট্রো স্টেশনের মাঝের এলাকায়।"


ইকবাল সেদিন একটা কথা হয়ত বলেন নি সাংবাদিকদেরকে। বা সাংবাদিকেরাও হয়ত তখন লিখেন নি।  


"আমার ভাই আন্দোলনে ছিল, আমরা বুঝতে পারি নি।"


*****


তথ্যসূত্র: প্রথম আলো

প্রকাশের তারিখ: ২৮ জুলাই, ২০২৪

ভার্সন: অনলাইন (https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/r58r8gagqm) 


*****


#RememberingOurHeroes

#JulyMassacre










Saturday, October 19, 2024

এ আবার কোন পাখি

ইগো 

আমার একজন প্রেমিক ছিল, খাওয়ার সময় নিজেকে দেখতে দিত না। চাইতো না আমি দেখি, ও কীভাবে চিবোচ্ছে, গিলছে,  গব গব করে খাচ্ছে বা পান করছে এবং দাঁতের ফাঁক থেকে মাংস চুষে বের করছে। 

সে চাইত না আমি তাকে সঙ্কটাবস্থায় দেখে ফেলি। 


পুরোনো "আমি" দেরকে 

সব পুড়ে ফেলো
আগে যা যা বলেছ, যত বাণী-ভবিষ্যৎবাণী, আদেশ উপদেশ সব 
লাগলে সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম করো

অভিযোগ করো না
অন্যের ঘটমানতার মধ্যে নিজের নৌকা ভাসিয়ো না
গলায় অন্যের কথা  
দাওয়াতে গিয়ে নাক নিচু করে ফালতু হাসাহাসি বাদ দাও:  
আহ এদের বাচ্চাকাচ্চা যদি কিছু কম হতো!

সংশোধন আবশ্যিক,
ফুল ফোটার মতন প্রয়োজনীয়
তুমি যখন এক হাতে স্ফটিক আরেক হাতে প্রতিশোধ নিয়ে এসে হাজির হও, তখন মনে রেখো একটা মেঠো আবাবিল যখন বসন্তে ফেরত আসে, দাগওলা পালকগুলি বাদ দিলে সেও এক নতুন পাখি।


তুমি অন্য মেয়েদের মতো নও

না, ওইরকম মায়া-মায়া ভাব নিয়ে নয়, তোমার শীতল কণ্ঠে, যেন তুমি চিন্তিত নও, সে ফোন করবে কি করবে না, তাতে তোমার কিছু আসে যায় না, আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলো,  এর চেয়ে কত ভালোদের সাথে যেতে পারো। তুমি সেই মিষ্টি ধাঁধার মতো, স্বপ্নময়ী, তবে বোতলের ঢাকনা আঁটা। তোমার কোথাও কোনো দুর্বলতার আভাস নেই।

না, তুমি অন্য মেয়েদের মতো নও, সে বলে, স্মিতমুখে। তুমি যা যা ফেলে এসেছো, সে ওগুলিরই প্রশংসা করে।


টুয়েন্টিস

প্রথম পাঁকা চুল খুঁজে পাই ঊনিশে, প্রথম কোন ছেলের সাথে শুয়েছি একুশে।মাসের পর মাস শুধু শিম আর কটন বল খেয়ে থেকেছি। বছরের পর বছর পার করেছি হাই তুলে। একটা লম্বামতন লাল জামা পরে রাস্তায় তোমার সাথে নেচেছিলাম, সেই রাতের তারুণ্য আর কখনো ফিরে পাবো না। অনেক কিছু মনে নেই, আর কিছু জিনিস কখনো পাল্টায় না। প্রথমত, প্রথম সিগারেট আর দ্বিতীয়ত শরীরের রোমাঞ্চ। একবার জেরুজালেমে একটা মেয়েকে চুমু খেয়েছিলাম,  ফিনফিনে একটা মেয়ে, চেরির মতন লাল ঠোঁট, তার ফোন নাম্বার রাখি নি। তাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরার জন্য এত কাতর হবো, এটা বুঝতে পারি নি। 

 
কলেজ বয়

তুমি এনেছিলে মদ, আর একটু হেসে বলেছিলে, আমি সব থেকে সুন্দর মেয়ে। আমি মদ গিলছিলাম আর তুমি দেখছিলে (তুমি অপেক্ষা করছিলে),  আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল, যেন একটা মসৃণ গর্তের দিকে আগাচ্ছি, তুমি খুঁড়বে বলে। 

(তুমি কী জানো, হরিণ শিকার আইনত দণ্ডনীয়, কিন্তু কোনো মেয়েকে মাতাল করাকে ডেটিং বলে)

আমার রুমমেট দেখেছিল, তুমি আমাকে বয়ে আনলে, সিঁড়ির কার্পেটের উপর দিয়ে হাঁটতে পারছিলাম না, ঘুমাচ্ছিলাম। 

(আমি যদি তাই চেয়ে থাকি?) 

সকালে তুমি জিজ্ঞেস করলে, আমি ঘুমাচ্ছিলাম কিনা। যেন আমার শরীরটাকে শুধু পোশাকই ধরে রেখেছিল, আমি যেন কখনো জেগে ছিলাম না।  



 কেট বেয়ার  



অনুবাদকের নোটঃ একটা সোভিয়েত গল্প আছে "এ আবার কোন পাখি" শিরোনামের, শিশুতোষ। আপাত পুরুষ হয়ে ইন্সটাগ্রামের নারী কবির অনুবাদ করা মুশকিল আছে। আমার প্রেমিকার সাথে প্রথম প্রথম আমি মাঝে মাঝে ইগো সংকটে ভুগতাম, পরে উনি আমার স্ত্রী হয়ে এসে ইগো সংকটকে রূপান্তরিত করে ফেলেছিলেন। 



Thursday, October 17, 2024

জাকারিয়া মোহাম্মদ এর ফেসবুক কবিতা

পরিযায়ী সারস
আমি তোমার কথা বলি
শুভ্র অলসতায় পতিত জমিতে...
এই সব নিয়ে আমার কবিতা।
আর ঘরের কাঠঠোকরাটি,
তার মাথার ছোট ঝুটি,
চাষের জমিতে দানা কুড়ানো,
তার কথাও বলি।
এমনই অবস্থা আমার, কবিতা সংশয়ী
এক পা বুনেছি পতিত জমিতে
আরেক খানা চাষের লাঙ্গল,
এই অক্ত গৃহবাসী মুকিমের তো
আর অক্তে দোয়া মুসাফির।



১৬ই আগস্ট, ২০১৩
জাকারিয়া মোহাম্মদ
রামাল্লা, প্যালেস্টাইন




Sunday, April 07, 2024

পশ্চিমের ''ফার্স্ট কাউ"

 ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২১ 





কলম্বিয়া নদীতে একটা জাহাজ চলছে, সেই দৃশ্য দিয়ে সিনেমার শুরু। পর্দার বাম থেকে জাহজটা তার স্বাভাবিক গতি নিয়ে পর্দার ডান পর্যন্ত যায়। জাহাজের ইঞ্জিন অতি আধুনিক, আকার প্রকান্ড। একই নদী আমরা যদি দুশ বা আড়াইশ বছর পেছনে গিয়ে দেখি, দেখবো আরেকটা জাহাজ। এটিও বাম থেকে ডানে ধীর গতিতে পার করবে, এই ইঞ্জিন আরেকটু ধীর হতে পারে। জীবনের অতি স্বাভাবিক গতিকে অতিক্রম করার উপায় নেই। ফিকশন, সিনেমায়, গল্পে, উপন্যাসে এমনকি বাস্তবে, কোন ইঞ্জিনই জীবনকে দ্রুতগামী করতে পারে না। ফার্স্ট কাউ সিনেমার প্রথম কয়েকটি দৃশ্য।




আমেরিকার উত্তরের ওরেগনের একটি ট্রেডিং পোস্ট এই সিনেমার গল্পের কেন্দ্রে। ট্রেডিং পোস্ট মানে সেই পুরানো দিনে, আমেরিকার পশ্চিম তখনো ইউরোপীয় সেটেলাররা পুরোপুরি দখলে আনতে পারে নি । যখন জীবন ধীর ছিল বললে আমরা আর আপত্তি করি না। ইউরোপে তখন পুঁজির ঢেউ লেগেছে, নতুন পৃথিবীর পশ্চিম বাকী পৃথিবীর মানুষেরা জয় করতে এসেছে। কোষে কোষে এখনো প্রাক-কৃষি যুগের ডিএনএ। সিনেমার মূল চরিত্র ফিগোউইতজ ওরফে কুকি প্রাক-কৃষি যুগের সংগ্রাহক গোছের, এই নতুন দুনিয়াতে রান্না ও রুটি ইত্যাদি বেকারী সামগ্রীর তৈয়ারে পারঙ্গম। বীভার শিকারী একটা দলের খোরাক যোগানোর কাজে নিযুক্ত হয়ে সেই দলের সাথে আমেরিকার পশ্চিম তীরের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্যারিসে তখন বীভারের চামড়ার হ্যাটের ফ্যাশন পড়ন্ত। নতুন ফ্যাশন কী হবে সেই দুর্ভাবনা করতে দেখি হাজার মাইল দূরের নেটিভ আমেরিকার সর্দারকে। কে বলে জীবন ধীরগতির!





জঙ্গলে মাশরুম খুঁজতে গিয়ে কুকি ফিগোউইতজ এর সাথে দেখা হয় চৈনিক কিং লুর। কিংলু ডায়াস্পোরা, ম্যারিল্যান্ডের কুকিও এক অর্থে ডায়াস্পোরা। ইউরোপীয়, চৈনিক, নিগ্রো, নেটিভ, ইহুদী, মুসলমান, ইন্ডিয়ান, আরব, গরীব, দুঃখী, ডায়াস্পোরা ইত্যাদি। কিংলু কুকির চেয়েও ভালো ইংরেজি বলে, অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান ও কুশলী, ক্যাপিটালিজম এর স্বপ্ন তার দুইচোখে, সান ফ্রান্সিসকোতে গিয়ে নতুন হোটেল খুলতে চায়। ক্যান্টন থেকে জাহাজে চড়ে লন্ডন ঘুরে ওরেগন পৌছেছে এই ডায়াস্পোরা। রাশিয়ান রা তার পিছু নিয়েছিলো। কুকি তার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। ফার্স্ট কাউ বন্ধুত্বের গল্প।





এই বাণিজ্য কেন্দ্রটিতে আমরা অনেক জাতের মানুষকে দেখতে পাই যারা সংগ্রামে লিপ্ত, জীবনের প্রত্যেকটি দিন ধীর গতিতে আগাচ্ছে, একটা দিনের পরে আরেক দিন টিকে থাকাই জটিল ও কঠিন। ডিরেক্টর চিত্রনাট্যের শৈল্পিক ধীরতায় পটভূমির মধ্যে নিয়ে আসেন কলম্বিয়া নদীর ধার, অরণ্য, কুটির, বাজার, বাজারের প্রাঙ্গনের কাঁদা, মানুষের অনিশ্চিত সংগ্রাম, তার মধ্যে ক্ষমতা ও সভ্যতার দ্বন্দ্ব। ঔপনিবেশিক চিফ এই ক্ষমতার পিরামিডের উপরে বসে আছেন, বাকীরা প্রায় নাই বললেই হয়। ওরেগনের এই আদিম কাঁদার পৃথিবীতে তার ক্ষমতা তাকেই শুধু লন্ডন (যা কিনা ততকালীন বিশ্বের তথাকথিত সভ্যতার উৎকর্ষের কেন্দ্র) এর আরাম আয়েশের কথা ভাবার সুযোগ দেয়। তার ইচ্ছে হয়, ইংলিশ চা পানের, লিকারের সাথে কিঞ্চিৎ গোদুগ্ধ। এর ফলেই সিনেমার হাজির হয় কেন্দ্রীয় আরেক প্রধান চরিত্র, গরু! প্রথম গরু, ফার্স্ট কাউ।




কলম্বিয়া নদী ধরে একটা ভেলা বা ফেরীতে করে এক দিন হাজির হয় গরুটা। পথে তার স্বামী ও সন্তানের মৃত্যু ঘটেছে। এই দুগ্ধবতীকে কেন্দ্র করেই এর পর আগাতে থাকে মানুষের আগ্রহ, সিনেমার গল্প।




ছোট বাণিজ্য কেন্দ্রটিতে পরিবর্তন আসছে। গরু চলে আসা একটা লক্ষণ। সেই গরু ঘাসের গালিচায় বাধা থাকে। তাকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত হয় শ্রমিক। কুকি রান্নায় পারদর্শী। একদিন কিংলুর মাথায় বুদ্ধি আসে, গরুর দুধ চুরি করার। চুরি করা অল্প দুধে কুকি বানায় বিস্কুট। সেই সুস্বাদু বিস্কুট খেয়ে কিংলু ব্যাবসার বুদ্ধি আটে।




এখানে এক পেগ হুইস্কির দাম দুই সিলভার। অত্র এলাকার মানুষ বহু বহু দিনের গরুর দুধের স্বাদ কী জানে না। কিছু মধু, দারুচিনি, ইত্যাদি সংগ্রহ করে কুকি আর কিংলু প্রথম দিন তৈরি করে ছয়টা তেলের পিঠা। বাজারে গিয়ে বসে যায় সেই ছয়টা পিঠা নিয়ে। বুদ্ধিমান কিংলুর কারণে বেশ ভালো দাম পায় সবকিছুর। উৎসাহিত হয়ে তাদের দুধ চুরি এবং তেলের পিঠা কার্যক্রম চলতে থাকে। কিংলু খুব বুদ্ধি করে যোগান সীমাবদ্ধ রেখে তেলের পিঠার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক লাভ হয়ে যায় অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই। ক্যালিফোর্নিয়াতে তখন অঢেল সুযোগ। অল্প টাকায় জমি পাওয়া যায়। দুই বন্ধু স্বপ্ন দেখতে শুরু করে কৃষি খামারের। প্রাক-কৃষি মানবের ধমনীতে পুঁজির আনন্দ।




রাতের বেলা কুকি প্রতিদিন যায় দুধ চুরি করতে। গাছে উঠে কিংলু পাহারা দেয়। আমাদের প্রাক-কৃষি মানব কুকি, প্রতিদিন গরুর কাছ থেকে অনুমতি নেয়, তার স্বামী ও সন্তানের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। গরু সম্ভবত সেই প্রথম দিকের প্রাণীগুলির একটা যারা মানুষের সাথে কৃষি যুগে প্রবেশ করেছিল। কুকির কথা যেন বুঝতে পারে গরুটা। লেজ নাড়ায়, মাথা নেড়ে সায় দেয়। এক সাথে পুঁজিবাদের সংগ্রামে সাথী হয়।




সুস্বাদু তেলের পিঠা খুব দ্রুতই মনোযোগ কাড়ে চিফের। চিফ কুকিকে ব্যাক্তিগত কাজে লাগায়। তার এক অতিথির জন্য ব্লুবেরি ক্ল্যাফোটিস বানানোর কাজ দেয়। কুকির রান্নায় খুব খুশি হয়ে চিফ তাকে গরু দেখাতে নিয়ে যায়। কুকিকে দেখে গরুটা স্বাভাবিকভাবেই লেজ নাড়ায়, মাথা এগিয়ে দেয় আদরের সাথে। চীফ ও অন্যান্যরা সন্দেহের চোখে দেখে, কিংলু ও কুকি প্রমাদ গোনে। এ যাত্রা বেঁচে যায় দুইজনেই। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে তো!




গল্পের এই জায়গা থেকে আমরা কোন পরিণতির দিকে যেতে চাই ঠিক করে নিতে পারি, বা চাইলে সিনেমাটাও দেখা যেতে পারে গল্পের খাতিরে। পাশেই কলম্বিয়া নদী, কুকি আর কিংলু চাইলে নদীর ভাটিতে পালাতে পারে, অন্যদিকে চিফের আছে বন্দুকবাজ বাহিনী। এই ঔপনিবেশিক ও পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার ন্যায়-অন্যায় সব চীফের পক্ষে। চৈনিক কিংলুর এর মতন এলিয়েন (জেনোফোবিক আমেরিকায়/পৃথিবীতে) আর কুকির মতন দুর্বল-পুঁজিহীন-অর্বাচিন যে অন্যায় করেছে দুধ সংগ্রহ করে তার কী শাস্তি বিধান করা যায়? দুইশ বছর পরের এই পৃথিবীতে কি গল্পটা ভিন্ন হবে? বা আজ থেকে দুইশ বছর পরে আমাদের কবর খুড়ে যারা আমাদের অস্থি-কঙ্কাল আবিষ্কার করবে তারা আমাদের ন্যায়-অন্যায়ের জন্য কি শাস্তি বিধান করবে? সেই নতুন পৃথিবীতে প্রাক-কৃষি মানব, গুহামানবের অধিকার থাকবে তো?




জোনাথন রেমন্ডের গল্পে পরিচালক কেলী রাইকার্ডের সিনেমা ফার্স্ট কাউ। সিনেমাটির শৈল্পিক ধীরগতির কথা বলেছি, কিন্তু এই ধীরগতি নিয়েই ক্লাইম্যাক্স এর দিকে নিয়ে যায় চিত্রনাট্য, থ্রিলার বলা যায় প্রায়। সেই ঊনবিংশ শতকের শুরুর আমেরিকার ওয়েস্ট তার জীবন ও মানুষ, তার দৈনন্দিন ভাবনা, বেঁচে থাকা, বন্ধুত্ব, ইত্যাদি নিয়ে এই ছবি। পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিবে। কত পুরানো? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য বর্তমানের উত্তর-ঔপনিবেশিক / নিও লিবারেল মানুষের অবসর প্রয়োজন।

Wednesday, September 28, 2022

পাখিসব করে রব

 


কোথায় ছড়াচ্ছে ধান উঠোনে কাকের সাথে

বুলবুলি, শালিক, ফিঙে এই সব পাখি
দুর্বাসার পেট চিরে ফরফর পাখা নেড়ে
উলু আর ঘুণেদের বাস্তবতা ও গণতন্ত্রে
পরিযায়ী সেই সব পাখি ছড়াচ্ছে
সংবেদ, নক্ষত্রের এক অলীক বাগানে
জেগে থেকে অমৃত সঙ্গমের আকাঙ্ক্ষায়।

Saturday, May 15, 2021

ইজরায়েল

 "...মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখো

একটু সচেতন হলেই দেখতে পেতে
গ্যাস চ্যাম্বারে তোমার মায়ের মুখ
রাইফেলের প্রয়োজন ফুরোতো
তুমিও বলতে পারতে-
এভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না কারো পরিচয়..."

(একজন খুনীর প্রতি) / অবরোধকাল - মাহমুদ দারবিশ (রামাল্লা, জানুয়ারি ২০০২)

জেরুজালেম ভ্রমণ নিয়ে একটা পুরনো বই পড়েছিলাম কিছুদিন আগে, ভারতে কর্মরত এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার। কোলকাতা থেকে অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত সেই আমলে। গ্যালিলির সমুদ্র, বেথলেহেম, নাজারেথ, এই সব গ্রাম, ভূমধ্যসাগর হতে দেখা ও পরে কাছ থেকে দেখা জুডিয়ার গ্রাম-পাহাড়গুলির রোমান্টিক বর্ণনা আছে সেখানে। ইজরায়েল পাসপোর্টে না থাকলেও, ইউটিউবের যুগে ইজরায়েল ভ্রমণ সম্ভব। আল জাজিরা বা বিবিসি/সিএনএনও আপনাকে তাদের মতন জেরুজালেম নিয়ে যাবে, পর্যটকেরাও নিয়ে যাচ্ছেন। ইজারায়েল নাই বললেই তো আর নাই হয়ে যায় না।

"দ্রাক্ষালতা, জর্ডাননদী, কাঠ, কাঠবাজার
কাঠবাদামের গাছ, গ্যালিলির সমুদ্র, ঝাঁকাভরা
মাছ, মাছবাজার, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে
প্রতিশ্রুত স্বপ্নভূমি।"

আমাদের কল্প জগতের আর বাস্তব জগতের ইজরায়েল বা জেরুজালেম ভিন্ন। এর মধ্যে পশ্চিম তীর আর গাজা এই দুই মোটেও রোমান্টিক না, পুরোপুরি রগরগে বাস্তব। ইজরায়েল পার্লামেন্ট, তাদের ফুটবল দল, তাদের খৃষ্টান ও মুসলিম জনগণ, গণতান্ত্রিক রীতিপদ্ধতি, তাদের জাতীয়তাবাদ, বিজ্ঞান, প্রতিরক্ষা, যুদ্ধ, গোলান উপত্যকা, অবশিষ্ট প্যালেস্টাইন ও তার বাসিন্দাগণ, সেটেলার ইত্যাদি ইত্যাদি অভিনব। ইতিহাসের তুলনায় এর অভিনবত্ব হয়ত খুব বেশি না। আর অভিনব অনেক কিছুই হয়ত এই মুহূর্তে ঘটছে, গাজা বা পূর্ব জেরুজালেমের সংযুক্ত ভূখণ্ডেই পাওয়া যাবে। হয়ত কোনো এক পরিচয়ের সূত্রে গেঁথে ফেলা কঠিন না।

পরিচয় নিয়ে দারবিশের একটা কবিতা আছে। কি আপনার পরিচয়? প্যালেস্টাইনের মানুষ? আরব? ইজরায়েল ভূখণ্ডের মানুষ? মুসলমান / খ্রিস্টান / ইহুদী? পরিচয় মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, হাজার হাজার বছর ধরে। এখনো, কোথায় পরিচয়ের যন্ত্রণা নেই? রাজনৈতিক সংখ্যাগুরু বা ক্ষমতা বলয়ের বাইরে যে কোনো ভূখণ্ডে বা এই বিশ্বে এমন কোনো "পরিচয়" আছে যা আমাকে আপনাকে নিরাপত্তা দিবে? কিংবা গ্লানিহীন রাখতে সক্ষম হবে? মানব পরিচয়? সে তো অনেকে মানতেই রাজি না। তাহলে কিসের মধ্যে পরিচয় খুজছি আমরা?

এই পরিচয় খোঁজ করা অবশ্য অনিবার্য, বৃহত্তর দোহাই, ক্ষুদ্রতর দোহাই, আপাত দোহাই ইত্যাদি আছে। খুব সহজে যদিও মীমাংসা হতে চায় না। তবে আপাত প্রশ্নটি দ্ব্যার্থহীন হওয়া চাই। সেটি হলো, প্যালেস্টাইন রক্ষা পাক, রক্ষা পাক গাজা, পশ্চিম তীর ও সেখানকার মানুষ । শান্তি খুঁজে পাক ইজরায়েল।



Sunday, October 25, 2020

যেভাবে আমরা মধ্যবিত্ত জীবনকে মেনে নেই


এক স্নিগ্ধ আলস্য
ভর করে পুনরাবৃত্তির কাঁধে
সাথে প্রতিভার স্মৃতি
উপরের পাটি ক্ষয়ে ফেলা
বাছুরটি এই দুনিয়ার চক্করে
দৌড়ে খুঁজে ফেরে
সর্বশেষ গোমেধ
যজ্ঞের আগুণের ওম

—————

আমরা সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে বিরাজমান থাকতে চাই, অথচ আমাদের প্রতি অঙ্গ প্রতিনিয়ত এই দায়িত্ব ছেড়ে পালাতে চায়। ব্রহ্মাণ্ডের মালিক কারণার্ণবে শুয়ে শুয়ে দিন কাটাচ্ছেন। শ্রমিকেরা নানান প্রকার ধর্মঘট ভাংচুর করছে, বলছে, দুনিয়ার মজদুরে এক হও। কিন্তু বিশ্বাস মিলে না। মেলার কথাও না, যারা নিয়ম-কানুন বানায়, তারা বলে, মালিকের খেলা সব। এক আর হয় না। ঊন সকলের নিয়ত ও নিয়তি ঐ ব্রহ্মাণ্ডে বিরাজ হতে চাওয়া পর্যন্তই।

—————

ব্যক্তি বা বিষয়ের জালে আটকা হয়ে ব্রহ্মান্ডের পানে ঝুলে থাকাই যদি নিয়তি হলো, হাত পা ছোড়াছুড়ি করে দেখা যায়। তাতে হয়তো জাল আরো ছড়াবে, মহাকর্ষ আরো ডুবিয়ে দিবে তার বক্র-পাঁকের মধ্যে।

—————

যে পথে যাওয়া হয় নি
যে পথে যাওয়া হলো
যে পথ ভাবা গেলো
যে পথ ভাবাও যায় নি

এই সকল ভাবনার ব্যকরণে
পদের শৃঙ্খলা ও বিদ্রোহে
শব্দগুলির ফাঁকে ফাঁকে
অনুচ্চারিত নীরবতার মধ্যে
পতিত ভূমির কাছে
আদর্শ ফসলের আকাঙ্ক্ষায়
অবাধ্য উড্ডয়ন কিংবা
উন্নয়ন শ্রম হয়ে বেঁচে থাকা

পথগুলি অনন্তর দীর্ঘশ্বাস।