১৭ই জুলাই, সকাল
আজকে আশুরা। ক্যাম্পের ওদিকে গেলে হয়ত আরও ভালোভাবে টের পাওয়া যেত। এইবারও কি অন্যবারের মতো আশুরার মিছিল হবে? সকালের নাস্তা করতে একটু দেরি হলো। রুটি আর ডিম ভাঁজি। কালশি রোডের এই ফ্ল্যাটটা একটু বড়।কিচেনটা ঠিকঠাক। ফিল্টার মেশিন থেকে গ্লাসে পানি নিতে নিতে রাকিবুল এর চিন্তা এলো বাসায় ফোন দিতে হবে। ছুটির দিনগুলিতে বাসায় সবাইকে এক সাথে পাওয়া যাবে।
"হ্যালো, তোমরা কেমন আছো?"
"নাস্তা করছি।"
কথা বলতে বলতে ওয়াশিং মেশিন টা চালিয়ে দিল। এই বাসায় আম্মা-আব্বাকে আনা যাবে। ঝিনাইদাতে বড় ভাই থাকাতে অবশ্য আরাম পান, কিন্তু ঢাকায় এলে আম্মার চিকিৎসার ভালো সুবিধা হতো।
"আম্মা ওষুধ খাইছেন?"
"অফিসে যাই কেমনে? কেন বাইকে করে।"
"তাড়াতাড়ি কি অফিস থেকে আসা যায় আম্মা? না আম্মা।"
"কী যে বলেন আম্মা! কাজ থাকে না?"
"আচ্ছা চেষ্টা করবো।"
"রাফসান কি করে?"
রাফসান ইকবালের ছেলে। রাকিবুলের বড় ভাই ইকবাল। ঝিনাইদায় সোনালি ব্যাংকে চাকরি করে। ঢাকার বাসাটা অনেকখানি গুছিয়ে এনেছে রাকিবুল। আব্বা বিমান বাহিনী থেকে রিটায়ার করার পর থেকে ঝিনাইদাতেই থাকেন।
"না আব্বা, আমি কোনো মিটিং-মিছিলে যাই না।"
"না না, আমাদের ওখানে তেমন কিছু নেই।"
"কথা হইছে এমআইএসটির জুনিয়রদের সাথে, অত ঝামেলা হয় নি।"
"হ্যাঁ বলবো পিয়াসকে।"
পিয়াস রাকিবুলের বন্ধু। ওকেও একটা ফোন দেয়া যায়, আজকে দেখা করা যায় একটু। মোটর সাইকেলটার সাইলেন্সারটাও ঠিক করতে হবে। ওর পরিচিত একটা গ্যারেজ আছে বলেছিল, দশ নম্বরের দিকে।
১৯ শে জুলাই, সন্ধ্যা
গতকাল থেকেই মন ভালো নেই হাফিজা খাতুনের। গতকাল সারাদিন বাড্ডা আর বনশ্রীতে দারুণ গোলাগুলি। সন্ধ্যায় দশ নম্বরে নাকি আগুন দিয়েছে, কাজিপাড়াতেও, পুলিশ সারাদিন গোলাগুলি করেছে, হেলিকপ্টার থেকে নাকি গুলি করছে। এগুলি কেমন ধরণের কথা! কালকে রাত থেকে ইন্টারনেট নেই, ফোনের নেটওয়ার্ক ভালো না। কতগুলি মানুষ মারা গেলো কে জানে।জুমার পর থেকে নাকি আরও বেড়েছে গোলমাল।ছেলেটাকে ফোন দেয়া দরকার।
"হ্যালো, তুমি কোথায়?"
"বাসা থেকে বের হইয়ো না।"
"ঢাকার অবস্থা কেমন?"
"তোমার আব্বার সাথে কথা বলবা?"
হাফিজা খাতুনের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক। বিমান বাহিনীতে ওয়ারেন্ট অফিসার ছিলেন। দুই ছেলে। ইকবাল ব্যাংকার। ছোটটা ইঞ্জিনিয়ার। স্ত্রী আছেন, নাতি আছে। নাতি এসেছে চাচার সাথে কথা বলতে।
"ছোট বাবা, ছোট বাবা।"
"তুমি চলে আসো।"
"মোটর সাইকেল করে চলে আসবা।"
"গাড়ী চলে না?"
"তাহলে এম্বুলেন্সে করে চলে আসবা।"
আবু বকর বুঝতে পারছেন ঢাকার অবস্থা ভালো না। মঙ্গলবারে রংপুরে বেগম রোকেয়ার একটা ছেলে মারা গেলো। সারা দেশে আরও কতজন। পরের দিন ছুটি বলে রক্ষা ছিল। ভেবেছিলেন বৃহস্পতিবার থেকে হয়ত আন্দোলন একটু কমে যাবে। মনে হচ্ছে এইবার বেশ সময় লাগবে সব ঠাণ্ডা হতে। রাতে কারফিউ দেয়ার সম্ভাবনা আছে।
কিছু ক্ষণ পর।
ছেলের কাছে ঢাকার অবস্থা ভালো নেই শোনার পর থেকে হাফিজা খাতুনের প্রাণটা ছটফট করছিল। ছেলে কোনো রাজনীতি বা অন্য কোনোকিছুর সাথে নেই। দুই ছেলেই এখন প্রায় প্রতিষ্ঠিত। বড়টা ব্যাংকে। ছোটোটা ইঞ্জিনিয়ার। একটা চাকরি পেয়েছে। বিসিএস এর জন্য পড়ছে। বড় ফ্ল্যাট নিয়েছে। হাফিজা খাতুন কিছুতেই আশ্বস্ত হন না। স্বামীর কাছ থেকে আবার ফোনটা নিলেন।
"এই রাতে গ্যারেজে কেন?"
"দশ নম্বরে কি করো?"
"তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরত যাও।"
"রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।"
"হ্যাঁ সাড়ে নয়টার মধ্যেই।"
"তোমার আব্বা এশার নামাজ পইড়া আবার ফোন দিবেন।"
বিয়েটা করিয়ে ফেলতে হবে। হাফিজা খাতুন বুঝে পান না ছেলে কি তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বললো কিনা যে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু উনি জানেন, ছেলে খুব শান্ত স্বভাবের।কোটা আন্দোলনের কোনো মিছিলে-মিটিং এ যায় না। তবু মন মানে না। কী একটা বাজতে থাকে মনের মধ্যে। এমন না তো, যে ছেলে আন্দোলনে যায়। আর মিছিল থেকে দূরে এসে এসে আমাদেরকে ফোন করে যাতে আমরা টের না পাই? আঠারো তারিখে মুগ্ধ নামের একটা ছেলে মারা গেছে, বিইউপিতে পড়তো, রাকিবদের এমআইএসটির পাশেই তো। ফ্রিজটা খোলেন হাফিজা খাতুন। নারকেল, গুড়, পুলি পিঠার পুরের সরঞ্জাম। রাকিবের পছন্দের। নাতিটা কি করছে দেখতে যান।
২০ শে জুলাই, সকাল
"জ্বি, পিয়াস ভাই।"
"দুপুরের মধ্যে ঝিনাইদা পৌঁছে যাব।"
"কারফিউ কেমন ঢাকায়?"
"না সমস্যা হয় নাই। সালমানরে ঠিকানাটা পাঠাইছেন। হ্যাঁ, ইকবাল ভাই এর সাথে কথা হইছে।"
"উনার আম্মা বার বার সেনস হারাই ফেলতেছেন।"
"ঠিক আছে ভাই, আপডেট জানাতে থাকবো।"
ফয়সাল। রাকিবের সহকর্মী। এম্বুলেন্সে, সাথে সালমান, আরেক সহকর্মী। এম্বুলেন্সে রাকিবের লাশ। গত রাতে ১১ টার দিকে রাকিবের ফোন থেকে হাফিজা খাতুনের কাছে আরেকটা ফোন গিয়েছিল। কথা বলেছিল পিয়াস, মৃত্যু সংবাদ জানাতে। একজন মহিলা রাস্তা পার হয়ে রাকিবুলের সামনে এসে পড়ে যায়, রাকিবুল মহিলাকে তুলতে গেলেই গুলিটা লাগে এসে।
পিয়াসই লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। সালমানের মোবাইল থেকে ঠিকানাটা পড়লো ফয়সাল। মহিষাকুণ্ডু, সার্কিট হাউজ রোড, ঝিনাইদা।
২৮ শে জুলাই, কোনো এক সময়
"জ্বি আমি ইকবাল"
"দাফন করা হয়েছে ২০ তারিখ দুপুরে, পারিবারিক কবরস্থানে।"
"আমাদের গ্রামের বাড়ি। গ্রাম বাসুদেবপুর, হরিণাকুন্ডু উপজেলা।"
ইকবাল, রাকিবুলের ভাই। একজন সাংবাদিক ফোন করেছেন। বেশ কয়েকটা পত্রিকার সাংবাদিক কথা বলেছেন। একটু ভয়ে ভয়েই আছেন সবাই। ভাই যে আন্দোলন এ ছিল না, সে কথা প্রশাসনকে বোঝাবে কে! এখনো পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেনি অবশ্য।
"১৯ তারিখ রাতে।"
"মিরপুর ১০ আর ১১ মেট্রো স্টেশনের মাঝের এলাকায়।"
ইকবাল সেদিন একটা কথা হয়ত বলেন নি সাংবাদিকদেরকে। বা সাংবাদিকেরাও হয়ত তখন লিখেন নি।
"আমার ভাই আন্দোলনে ছিল, আমরা বুঝতে পারি নি।"
*****
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো
প্রকাশের তারিখ: ২৮ জুলাই, ২০২৪
ভার্সন: অনলাইন (https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/r58r8gagqm)
*****
#RememberingOurHeroes
#JulyMassacre