Saturday, March 21, 2020

ঈশাখাঁ এক্সপ্রেস

ঈশাখাঁ এক্সপ্রেস




আমাদের এই গল্পটা পৃথিবীর। সেখানে প্রথম চরিত্রের নাম টেপি। টেপির বয়স কত? টেপি স্ত্রীলোক। বয়স না বলি। পুরুষেরা টেপিকে কামনা করতে পারেন আর স্ত্রীরা ঈর্ষা করতে পারেন, তবে ভিন্ন ভিন্ন কারণে। তাতে বয়স কোনো বাঁধা বা সুবিধা না হোক। টেপির জামাই নাই। মারা গেছে, এতে টেপি খানিক যৌন-অবদমিত হতে পারে, আবার আশেপাশের পুরুষ লোকেরা তার উপর নানান সুবিধা নিয়েছে এমনও শংকা আছে। টেপির বুদ্ধি আছে। অসহায়ের সহায় ঐটুক। টেপি একদা ঢাকা শহর গিয়েছিল কর্মসন্ধানে, বা কর্মই তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। এক কেরানী বা মাস্টারের ঘর সামলানোর কাজে। কেরানী বা মাস্টারের ঘর যেমন হয়। গিন্নী আছেন, তায় আবার দুটি সন্তান। একটুকু বাসা, ঢাকায় যেমন হয়। তা এইখানে রাধো, এইখানে হাগো, এই খানেই খাও, এই খানেই শোও। এইসব তার সয়নি। ঐ অল্প আয়ের সংসারে খেয়ে-পরে অল্প বেতনে থাকা যেত, কিন্তু তাতে আর যা প্রয়োজন হয় সেখানেও গিন্নি-কর্তা বড়ই কৃপন। লোকটা দূর সম্পর্কের কেমন যেন ভাই হয় টেপির। আজও দেখা হলে টেপি তারে সালাম দেয়, বাচ্চাদুটির গাল টিপে দেয়। গিন্নি বলেন, “থাকলেই পারতি”।




এ যে শুধু কথার কথা নয় তা বোঝাতে লম্বা শ্বাসও ছাড়েন। টেপি যেন নিজের অপরাধ মেনে নিয়ে চুপ করে থাকে।




টেপি কামলা যায়। এখন পুরুষ পায় তিনশ পঞ্চাশ আর মেয়ে লোক পৌনে তিনশ। সেগুলি পাট আর পেঁয়াজ রোয়ার সময়। বছরের বাকীদিনগুলিতে মেয়েলোকের দরকার নেই। ঐ সময়গুলিতে হয় গেরস্ত বাড়িতে যায়, নয় দাওয়ায় শিকা বানিয়ে, কাঁথা সিলিয়ে চলে। একলা মানুষ হওয়ায় পেট চলে যায়, মাঝে মাঝে ভাতিজাটিকে আদর করে ডাকে, "সুকু, আয় রে, আজকা আমার লগে খাইতি বইস।"




সুকু ছেলেটিও বুদ্ধিমান। স্কুলের পড়ায় বিদ্বান হবার সম্ভাবনা রহিত, উপরন্তু সংসার বাড়ন্ত। বাপের রোজগারে শখের স্কুল চলবে না। এইটুকু বোঝার পর সুকুর বুদ্ধি বিস্তর বিপাকে ফেললো। কোন কাজে যোগ দেয়া যায়? কিছুদিন সদরের বাজারে এক রঙের দোকানে ওস্তাদের সাগরেদ হলো, তার পাশের ঘরের নিলু ঢুকেছিল তরকারি বেঁচায়। সকালের মেইলে কাওরানবাজার যায়, ফিরে আসে নয়টার আগে, এসে বাজারে বসে যায়। নিলুর কাছে ঢাকা শহর, তার রোমাঞ্চ, ইত্যাদি সুকুর প্রাণ পাগল করে ফেলে। ওস্তাদকে ফাঁকি দিয়ে ক'দিন গিয়েছিল কারওয়ানবাজার। বাজারে নিলুর ভিটেতেই বসেছিল। তরকারির বেঁচার টাকা লাভও হয়েছিল অল্প। কিন্তু ওস্তাদকে কি ফাঁকি দেয়া যায়? রঙের দোকানের চাকরি গেছে। ওস্তাদ বাড়ি এসে বাপমা কে বিদায় বলে গেছে। সুকুর সময় নাই, কিছু একটা স্থিরবুদ্ধি করতে হবে। বাপ ক্ষেতে মজুরি দেয়। প্রায় সারা বছর। সুকু দেখতে পায়, ক্ষেতের কাজ কমে আসছে। ক্ষেতই শালার কমে আসছে।




টেপি, সুকু, নীলুকে নিয়ে আমরা এগোতে পারি। কাজ মানে জীবন। এই তিনজনের জীবনের কথা বলা হলো। এর বাইরেও এরা মানুষ, মানে যতটা আমরা মানুষ। এইযে গল্প বলা হচ্ছে, এমনি গল্প তারাও বলে বা শোনে। টেপিকে বলে তার ভ্রাতুষ্পুত্র সুকু, নীলু সাক্ষী দেয়। কাওরানবাজার থেকে ফেরার পথে, সেদিন ট্রেন মিস করেছিলো, ঈশা খাঁ এক্সপ্রেস। ঈশা খাঁ কোনোদিন চড়েন নাই ট্রেনে, আর এরাও জানে না সম্রাট ঈশা খাঁর জীবনের কাহিনি, মেঘনার চরে তার দুধর্ষ প্রতিরোধ।



Image result for ঈশাখাঁ এক্সপ্রেস
ছবি ইন্টারনেট থেকে চুরি করা





ঈশা খাঁ ট্রেন ফেল করে দুইজনে বিশ্বরোড থেকে উঠেছিল বাসের ছাদে। সেই বাসের হেলপারের গল্প করে তারা। কত রাত না ঘুমিয়ে সে হেলপারি করে ওস্তাদের সাথে। কোনোদিন স্টিয়ারিং এ হাত দিবে, সেও স্বপ্ন দেখে, তার গল্প সে করে বাসের ছাদে, নীলু আর সুকুর কাছে। গল্পের মাঝে গল্প, তার মাঝে আবার গল্প। তরকারির বোঝা নিয়ে জামতলা নেমে যায় তারা বাস থেকে। টেপি মিলাতে থাকে, সেও কোনোদিন গিয়ে থাকবে বিশ্বরোড বাসস্ট্যান্ডে।




বিশ্বরোড বাসস্ট্যান্ডটা কেমন? আছে অনেক মানুষ। শরবতের দোকানদার আছে। অনেক ঠান্ডা হবে বুঝি সেই সব দুপুরের রোদের শরবত। দুই হাতে দুই গ্লাস ধরা লোকটা অবলীলায় ডান থেকে বায়ে আবার বাম থেকে ডানে গ্লাস থেকে গ্লাসে পানীয় চালান করে এক ফোঁটাও পড়ে যায় না। সুকু অবাক হবার মতন তাকিয়ে থাকে, টেপিও তাকিয়ে সুকুর চোখের মধ্যে দেখতে থাকে শরবত বিক্রেতার দক্ষ দুই হাত। কত টাকা গ্লাস? সারাদিনে কত টাকা বেঁচে? কয় টাকা দেয় পুলিশ আর নেতাদের? এইসব হিসাব জানে না সুকু, নীলু, টেপি। না জানার রহস্য এই শরবত বিক্রেতার পেশাগত জীবনের প্রতি ঈর্ষা হয়ে জমা হয়ে যায়। প্রথম প্রহরের কড়া রোদে ঠান্ডা শরবতের প্রতি।





টেপি তার মরে যাওয়া জামাই এর কথা ভাবে। খুব বেশি দিন সংসার করা হয় নাই। সাপে কেটে লোকটা মরে গেছিল। টেপির বাপ তখন বেঁচে ছিল। একটা এতিম ছেলেকে জামাই করে এনে ভিটের একটা অংশ লিখে দিয়েছিল। ভিটেটার তেমন আর বাকী নাই। ভাই এর ঘর, তার ঘর লাগোয়া দাওয়াটুকু। বাপ জাল বাইত, টেপির ভাইও তাই। জামাই তাদের সাথে বেলাইয়ের বিলে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলো একদিন। বেলাইয়ে টেপিও গিয়েছে কতদিন, ঐ ঘটনার আগে ও পরে, তালের কোন্দা বেয়ে বেয়ে। না লখিন্দরকে নিয়ে নয়, তার খোঁজেও নয়। পেটের তাগিদে। ঐটুকু জীবনে লৌকিক আর অলৌকিকের পার্থক্য সে বুঝে গিয়েছিল।একটা খাড়া, দু-চারটা বড়শি বা ছোট জাল দিয়ে ছোট-মাঝারি মাছ উঠতো তখন। এখন সব মাস্তান বাহিনী লিজ নিয়ে নেয়। কোন্দা নিয়ে এগোলেই হই হই করে মারতে আসে। আগে বিলের খোঁজ থাকত প্রায় বারো মাস। এখন পানি কমে যাচ্ছে সবখানে, বানের পানি আগের মতন আর আসে না। এখন তার ভাই মানে সুকুর বাপও বাধ্য হয়ে জাল ছেড়ে মানুষের জমিতে কামলা দেয়। এই সুকুর বয়সই বা কত? লৌকিকতার অপরিহার্যতা সেও বুঝে গেছে, যাচ্ছে।




নিলু বলে তরকারির ব্যবসার কথা। কাওরান বাজারের বড় বড় আড়ত, সেইখানে স্তুপ করা কত কত সবজি। টেপির চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে কোনদিন কাওরানবাজার দেখে নাই।




"খালি সবজি রে?"




"না মাছের বাজার, মশলা, ফল-ফুরুট, কত তা"।




ট্রাকে করে আসে সব, বগুড়া, বাগেরহাট, নরসিংদী আরো কত কত জায়গা থেকে, সেইসব ট্রাক, সারা রাত চালিয়ে ভোরে এসে মাল খালাস দেয়। সেখানেও কত লোকের কাজ। খোদার দুনিয়ায় কাজের অভাব নাই। তবে বুদ্ধি রাখতে হয়। যেমন লাউ বা বরবটি গাজীপুর চৌরাস্তার ঐখানে এক বাজার থেকে কিনলে আরো সস্তা পরে, লেবু, বেগুন ঘোড়াশাল। এইসব নীলু জানে, সুকু এখনো এতটা শিখে উঠে নাই। নীলু তার বন্ধু, কাজের সাথী। নিলুর এই জ্ঞান তার মধ্যেও অহংকার তৈরী করে, টেপিরও ভালো লাগে। দুটি কিশোর পৃথিবীর পথে বের হয়েছে, সেও তাদের সাথে মানস ভ্রমণে আছে। পথে তো আছে সেই কবে থেকেই!




"সব থেকে বড় কথা কি জান, মালিকের গেঞ্জাম নাই।"



নিলু তরকারির ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই যে নিলু সুকুকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাজারে ডেকে আনছে, এই উদার মনোভাবটাও সে জাহির করে।




"সব খানে এমুন পাইবা? গেছিলাম তো কয়দিন গ্যেরেজে ঐ পাড়ার চান্দুর লগে।”




"চান্দু ভাইয়ে অনেক টাকা কামায় না?" সুকু আগ্রহ দেখায়।




"কামাইতে পারে তোমার ভাইয়ে, তোমার লইগা কাঁচকলা"।




বেশ কিছু দিন চান্দুর সাথে গ্যারেজে কাজ শিখতে গিয়েছিল নিলু, টেকেনি। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি অনেক ছোট ছোট কাজ করে যেতে হয় ওস্তাদের সাথে। চান্দুর মতে সে আট বছর ধরে মালিকের সাথে থেকে থেকে শিখে এখন গাড়ির ইঞ্জিনে হাত লাগাতে পারে। নিলুর মতে এগুলি "ভাউ", পেশাগত নিরাপত্তার জন্য তৈরি ঢাল। নিলু-সুকু দুইজনেই বোঝে সব খানে এই ঢালগুলি আছে। তরকারির ব্যবসায় মালিকের গেঞ্জাম নাই, তবে বাজারে বসতে চাইলে বছরান্তি ভিটভাড়া তো গুনতে হবে। সেটা ব্যবস্থা হলেও, কিন্তু প্রত্যেক দিনের ধকল আছে। ঈসাখাঁ কারো জন্য অপেক্ষা করে না।


--------


এই গল্পের পরিণতি কোনদিকে। এই সুকু-নিলু-টেপি এখন ঘরের ছোট দাওয়াটায় বসে আছে। তিনজনের মাথার মধ্যেই তিনটা পৃথিবী। নাকি একটাই পৃথিবী, তিনজনে ভাগাভাগি করে আছে? এই প্রমান পৃথিবীর অংশীদার করে নিতে পারলে সুখ হয়, এই সুখটা এদের এই মুহুর্তে আছে। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না। সুকু তরকারির ব্যবসায় নামতে পারবে না, মূলধন স্বল্পতা, ব্যবসার অনিশ্চয়তা বা এরকম আরো অন্য অনভিগম্য কোন কারণে। সেরকমই কোন এক কারণে, নিলু ত্যাক্ত হয়ে নিজের মতন ঈসাখাঁ এক্সপ্রেসকেই নিয়তি ধরে আগাবে। এই দাওয়াতে একই পৃথিবীর স্বপ্ন তার কাছে প্রগলভতা হয়ে থেকে যাবে। সুকু আরো দু-চারটা কাজের-ধান্ধার চেষ্টা করবে, ফেল করবে বার বার, স্কুলের ফলের মতন। ক্ষেতের কাজ কমে গেছে, টেপি, সুকুর বাপ, সুকু, এদেরকে নিয়ে আরো আগানো যেত। গল্পকার আপাতত এদেরকে ঘোড়াশালে একটা বড় কোম্পানীর ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এই ঘোড়াশালের ব্রিজের উপর দিয়েই প্রত্যেক দিন ঈসাখাঁর নামধারী ট্রেনখানা দুইবার যায়, নিচে শীতলক্ষ্যা।