Thursday, May 18, 2017

World of Yesterday / Stefan Zweig


"রয়্যাল গেম" যখন প্রথম পড়েছিলাম তখন জানতাম না যে ওটা ছিল স্তেফান সোয়েইগের শেষ লেখা। একটা গল্পে কতটুকুই বা জানা যায়? মিখাইল তালের জীবনী খুব টেনেছিল, দাবা খেলার ইতিহাস ও খেলাটাকে ভালো লাগে, তার সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি মিলে অত্যন্ত সুখপাঠ্য ছিল "রয়্যাল গেম"। এর পর? এর পর রবীন্দ্রনাথ এর ইউরোপ ভ্রমণের কাহিনী পড়তে পরতে পেয়ে গেলাম রোমা রল্যার খোঁজ। স্তেফান সোয়েইগ আস্ত একখান বই লিখেছেন রল্যাকে নিয়ে, ইউরোপের শ্রেষ্ঠ চিন্তক মনে করতেন তাকে। 
শুরু করলাম, সোয়েইগের আত্মজীবনী "ওয়ার্ল্ড অফ ইয়েস্টারডে" ইংরেজি অনুবাদে। এখানে ব্যাক্তি সোয়েইগের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। সবটাই লেখক সোয়েইগ। শুরু করেছেন, সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শান্তিময় দিনগুলিতে। স্কুলে তখন ফ্যাশন ছিল কিছু একটা নিয়ে মেতে থাকার। দস্তয়েভস্কির উপন্যাসের নায়কেরা যেমন পিতার্সবুরগের রাস্তায় একেকজন দর্শন বা মতবাদ দিয়ে যাচ্ছেন, ভিয়েনার আবহাওয়ায় তখন দারুণ ফ্যাশন। সোয়েইগের সহপাঠীরা ব্যস্ত কবিতা নিয়ে। সেই থেকেই শুরু।
যে যুগের কথা বলছেন, সেটি যেন বড়োদের বা বুড়োদের যুগ। ছোটোরাও কত দ্রুত বড় হওয়া যায় তাই নিয়ে ব্যাস্ত। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আসছে কীভাবে দ্রুত দাঁড়ি গজানো যায়। ব্রিফকেস নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে তরুণেরা যাতে তাদের বড়ো বা পরিণত দেখায়। ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার বাঁধ চারিদিকে। ঠিক সেসময় কি পড়ছেন সোয়েইগ ও তার বন্ধুরা? রিলকে, নীটশে, কিয়েরকেগার্দ, যেখানে যা পাচ্ছেন বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে পড়ে চলেছেন। শিক্ষকেরা? সোয়েইগের মতে, ভিয়েনার স্কুলগুলির ছিল পাঠ্যক্রমের গর্ব। যেন সর্বোচ্চ উৎকৃষ্ট পাঠ্যক্রম তৈরি আর তার মধ্যও দিয়ে বের হয়ে আসবে শ্রেষ্ঠ ও বাধ্যগত একটা তরুণ প্রজন্ম, বুড়োরা তাই চাইতেন। সোয়েইগের শিক্ষকেরা কোনোদিন তার বা তার অন্যয়ও সহপাঠীদের মনের ঠিকানা জানতেন না। স্কুলে থাকতেই "অচল" শিক্ষকদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে গিয়েছিল এই তরুণ প্রজন্ম।
পুরো বইটা তো আর সারমর্ম করা যাবে না এখানে। সোয়েইগের লেখক জীবন, উত্থান সাফল্য বন্ধুত্ব, তার মাঝে চমৎকার ভাবে এসেছে রল্যা, ভ্যারহারে, রিলকের সাথে তার বন্ধুত্বের স্মৃতি- জয়েস, রোঁঁদ্যা, দালি, স্ট্রস, ফ্রয়েড। শুরুতে নিজেই প্রচুর অনুবাদ করতেন, পরে জীবদ্দশায় সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনুদিত লেখক।
সোয়েইগ লন্ডনে তার সাথে ইয়েটস এর দেখা হবার বর্ণনা দিচ্ছেন। একটা কবিতা পাঠের আসর। একটা জনাকীর্ন ছোট ঘরে, অন্য সব বাতি নেভানো। কালো একটা পড়ার টেবিল বা ডেস্ক। তাতে দুইটা বড় বড় সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালানো। ইয়েটস পড়া শুরু করলেন। সোয়েইগের মনে হলো যেন একজন সাধু-সন্ত কবিতা পাঠ করছেন, লোকজন চেয়ারে এমনকি মাটিতে বসেও শুনছে । তার মনে পড়লো সরল, সহজ ও নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে রিলকে বা ভ্যারহারের কবিতা পাঠের স্মৃতি। সোয়েইগের ভাষায়, "...in spite of my love for his work I was somewhat distrustful of this cult treatment."
সোয়েইগের নাট্যভাগ্য খুবই মরবিড। প্রথম নাটক গ্রীক মিথলজির উপর, ট্র‍্যাজেডি। আর তাতে এক গ্রীক বীরের চরিত্র করতে চাইলেন, ততকালীন জার্মান রাইখের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার একজন, ম্যাটকোভস্কি। দুর্ভাগ্য সোয়েইগের বা ম্যাটকোভস্কির, রিহার্সেল শুরু হবার পর অভিনেতা মারা গেলে বার্লিন থিয়েটারের নাটকটি আর নামে নি। একই নাটকে এর পর অন্য প্রধান চরিত্র করতে চাইলেন যোসেফ কাইঞ্জ, ভিয়েনিজ থিয়েটারের সুপার স্টার। এমনকি সোয়েইগকে তার জন্য একটা একাঙ্কিকা লিখতেও বললেন। ভিয়েনার প্রসিদ্ধ বুর্গথিয়েটারে মঞ্চস্থ হবে। সবকিছু ঠিকঠাক। রিহার্সাল শুরুর আগে ক্যানসার আক্রান্ত কাইঞ্জ মারা গেলেন। সোয়েইগ যদিও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন না, কিন্তু এই প্রিয় মানুষগুলির মৃত্যুতে অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলেন। মইসি ছিলেন আরেক জার্মান অভিনেতা, কাইঞ্জের যোগ্য উত্তরসুরি। তিনি এবার চাইলেন কাইঞ্জের ফেলে যাওয়া চরিত্রটিতে অভিনয় করতে। সোয়েইগ রাজি হলেন না। বহুদিন পর, মইসি আবার এলেন অন্য অনুরোধ নিয়ে। ভিয়েনার মঞ্চে পিরানদেল্লার নাটক হবে, মোইসি অভিনয় করবেন। পিরানদেল্লার শর্ত সোয়েইগ যেন জার্মান অনুবাদের দায়িত্ব নেন। সোয়েইগ রাজি হলেন। অনুবাদ সমাপ্ত করলেন। ১৯৩৫, মুসোলিনিও হাজির হবেন, ইতালী-অস্ট্রিয়ার বন্ধুত্বের রাজনীতি দীর্ঘজীবী হবে। এমন সময়।মোইসি মারা গেলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত হয়ে।

প্রচুর ভ্রমণ করেছেন। প্রতিটি ভ্রমণ তাকে বদলে দিয়েছে। ভারত ভ্রমণের পর তার নিজের ভাষায়, "Many a detail that had formerly occupied me unduly seemed petty after my return, and I ceased to regard our Europe as the eternal axis of the universe." সোয়েইগের নিউ ইয়র্ক ভ্রমণের বৃত্তান্ত দারুণ। এর আগে গোর্কি, এক্সুপেরী, দালি আর পপারের আমেরিকা ভ্রমণ এর হালকা পাতলা অভিজ্ঞতা-বর্ণনা পড়া ছিল। সোয়েইগের ভাষায় তার আমেরিকা আসার কারণ, "I was one of the very few writers who went over not to earn money or to exploit America journalistically, but solely to compare a rather uncertain impression of the new continent with the reality." তখনকার ম্যানহাটন অত জাঁকজমক পূর্ন নয়, কিছু কিছু স্কাই-স্ক্র্যাপার দাঁড়িয়ে গেছে, কিন্তু বেয়াড়া ভাবটা রয়ে গেছে, সিনেমা, বা আর্ট গ্যালারির পরিমাণ কম। প্রথম ঘোর কাটার পর সোয়েইগ, রাস্তার ধারের চাকরির বিজ্ঞাপন গুলি দেখতে শুরু করলেন, এবং খোঁজ নিতে লাগলেন। অচিরেই পাঁচটা চাকরির সন্ধান পেয়ে গেলেন, যার মাধ্যমে একজন নবাগত এই শহরে মাথা গোজার ঠাই নিশ্চিত করতে পারে। এই চাকরি সন্ধান কল্পে কেউ তার ধর্ম, জাতীয়তা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। সোয়েইগ জানলেন এই নতুন রাষ্ট্রটিকে, তথাকথিত ইউরোপিয়ান ঔদ্ধত্যের বাইরে গিয়ে।
স্তেফান সোয়েইগ তার আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মনোভাব নিয়েও প্রথম মহাযুদ্ধ এড়াতে পারেন নি। কোনোমতে যুদ্ধকালীন দেশসেবা করেছেন লাইব্রেরিতে দায়িত্ব নিয়ে। এর মধ্যে একদিন দরজায় নক। বাইরে দেখেন রাইনার মারিয়া রিলকে, সৈন্যের পোষাকে। He looked too touchingly awkward, his collar too tight, disturbed by the thought that he had to salute every officer, clicking his heels together....For the first time he no longer looked young; ... "Abroad" he said "if one could only go abroad! War is always a prison". Then he left. এরই মাঝে খুঁজে পেলেন রল্যাকে। সেও এক কাকতাল। রল্যার জঁঁ ক্রিস্তফই যেন আধুনিক ইউরোপের নায়ক। প্রথম মহাযুদ্ধে যার পরাজয় প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছ থেকে। সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন, প্রথম যুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝের সময়টায়। ১৯৩৪ পর্যন্ত। রাইখস্ট্যাগ পোড়ানোর সময় সিনেমা হলে চলছিল, সোয়েইগের কাহিনীর তে তৈরি সিনেমা "দ্য বার্নিং সিক্রেট"! গোয়েবলস-হিটলারকে বেশ যন্ত্রণায়ই ফেলেছিলেন। আরো একবার স্ট্রসের সাথে অপেরা নিয়ে।
সোয়েইগ এর অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ, পক্ষপাত হীন, "One who aims to depict his time as honestly and clearly as possible must also have the courage to disappoint romantic conceptions!" ভিয়েনার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, বা রাশিয়ার বলশেভিক রাষ্ট্র, মুসোলিনির ফ্যসিস্ট ব্যাবস্থা বা চেম্বারলেইনের পররাষ্ট্র নীতি, এমনকি হিটলারের উত্থানকেও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন নির্মোহ ভাবে। দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে আশ্রয়হীন সোয়েইগ ব্রাজিলে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে একত্রে আত্মহত্যা করেছিলেন প্রচণ্ড মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে। লেখক, তার নিজের দেশে, নিজের ভাষাভাষী মানুষের কাছে নিষিদ্ধ, বাঁচবেন কি উদ্দেশে?
একটা জায়গার বর্ণনা না দিয়ে পারছি না। জানি না, ভালো লাগবে কিনা। সোয়েইগ গিয়েছেন ইতালি সোরেন্টো, গোর্কির সাথে আছেন। তিনদিন ছিলেন। এর আগে রাশিয়া তে যখন গিয়েছেন, ট্রেন স্টেশনে বা অন্যত্র রাশিয়ান লোকজন, শসা বা মাংস বিক্রেতা, কৃষক এমনকি রাশিয়ান স্তেপ, সবই তার পরিচিত লেগেছিল, বুঝতে পেরেছিলেন দস্তয়েভস্কি, গোর্কি, তলস্তয়ের পড়ার প্রভাব। গোর্কিকে রাশিয়ান কৃষকের মতই দেখতে। তো সোরেন্টোকে একদল রাশিয়ান নাবিক এসেছে, বন্দরে নেমেই তারা খোঁজ নিতে শুরু করেছে, তাদের লেখক কই? সোরেন্টোর মূল্য ঐ নব উদ্যমী বিপ্লবী নাবিক সেনার কাছে ঐ। হই হই করে লেখকের বা বাড়ি খুঁজে নিয়ে নাবিকেরা হাজির। গোর্কি তাদের অভ্যর্থনা করলেন। এই আবেগী নাবিকের দল, লেখকের প্রতি তাদের অধিকারে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, "লেখক তুমি এই বুর্জোয়া ধরণের বাড়িতে কি কর? আমাদের সাথে চলো।" গোর্কি তখন স্বাস্থ্যগত কারণে সোরেন্টোতে। নাবিকদের প্রশ্ন কে বেশ প্রশ্রয় দিয়ে গ্রাম্য কৃষকের মতন মাথা নাড়িয়ে অপরাধবোধে ভুগছেন। আরো আরো অনেক অনেক ঘটনা। লন্ডনে ফ্রয়েডের শেষ দিনগুলি।

সব মিলে সোয়েইগ নিজে আছেন।