Saturday, September 03, 2016

ফ্যান্টম অফ চিটাগাং

বত্রিশ

আমার আর ডাক্তারের লাদাখ সফরে আসার আগে অনেক ভয়ভীতি যেমন কাজ করেছে, তেমনি প্রচণ্ড কৌতূহল ছিল। আমরা বেশ কিছু ডকুমেন্টারি ও ইউটিউবে পর্যটক দের  ভিডিও দেখেছিলাম আসার আগে। তাতে নিসর্গের চমকের এতটুকু ক্ষতি আসলে হয় নি। মাইলের পর মাইল রুক্ষ পর্বত, সবুজ-ধুসর গ্রাম, মানুষ, সেনাবাহিনী, নির্মাণ কর্মী, মোটর সাইকেলের পিছনে স্ত্রী বা বন্ধুকে নিয়ে আরোহী, স্কুল ইউনিফরম পড়া লাদাখি শিশু, লাল বা হলুদ লামা, কৌতুহলের শেষ নেই। নামগিয়াল যখন চ্যাঙসঁপা তে নামিয়ে দিয়ে গেলো, আমরা ততক্ষণে পথশ্রান্ত, কিন্তু ঘোরের মধ্যেই অছি।

গ্লোবাল এক্সপ্লোরার এর নামগিয়াল টিকেট রেডি করে রেখেছিল, ১১ তারিখ সকালে গো এয়ারের ফ্লাইট, সকাল ৭টায় লেহ-দিল্লি। ২ ঘণ্টা আগে রিপোর্টিং। নামগিয়াল কে সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ দিয়ে আমরা লারদাক এর দিকে গেলাম। লারদাকে গিয়ে দেখি কর্তা-কর্ত্রী কেউ বাড়ি নেই, আমরা সুন্দর মতন টেরেসে বসে ব্যাগ ইত্যাদি ফেলে কিছুক্ষণ ইন্টারনেট ইত্যাদিতে ব্যস্ত হলাম। এর মধ্যে লাকি অবশ্য বেশ কয়েকবার উঁকি ঝুঁকি দিয়ে গেলো, তার আচরণে মনে হচ্ছে, সে আমাদের চিনতে পেরেছে। কর্তা এলেন বেশ অনেক ক্ষণ পর। আমরা চাবি নিয়ে রুমে ঢুকলাম। আজকে আর কোথাও যেতে চাই না, রাতের খাবারের জন্য বলে দিলাম জুলে দিদি কে।

এবার ফেরার পালা, তবে আমাদের হাতে আরো একদিন আছে, সকালে তেমন তাড়া নেই। তবে ডাক্তার কিছু স্যুভেনির কিনতে চায়, আমার ইচ্ছা শান্তি স্তুপা টা দেখে আসা। জুলে দিদি আমাদের কথা দিলেন পরের দিন সকালে তিব্বতি মার্কেটে নিয়ে যাবেন। এখন একটু আরাম। আমার খুব থুকপা খাবার শখ ছিল, জুলে দিদির কথায় বুঝলাম, নেপালে আমি যে থুকপা খেয়ে আহ্লাদিত ছিলাম, ওটার সাথে লাদাখি থুকপার পার্থক্য আছে, আর একেবারে শীতের সময় চারা সেটা করাও হয় না। আমাদের রাতের খাবার, সুগন্ধি ভাত, পালং শাক, রাজমাহ, দই আর সাথে চমৎকার সালাদ।

সকালে ইচ্ছে করেই একটু দেরী করে উঠলাম। নাস্তা হলো পরোটা, জেলি, অমলেট সহকারে। জুলে দিদি তৈরি হয়ে আসলে আমরা লারদাকের আরেকটা গেট দিয়ে বের হয়ে আসলাম । এদিক দিয়ে আমরা এতদিন যাতায়াত করিনি, অল্প একটু হাটতেই তিব্বতি মার্কেট পাওয়া গেলো, আমাদের গৃহকর্ত্রী লাদাখি পোশাক পরে সরকারি কোন কাজে যাচ্ছেন মনে হলো। তিব্বতি মার্কেট থেকে আমরা কিছু চাবির রিং কিনলাম। জুলে দিদি আমাদের রেখে তার কাজে গেলো।

আমরা কিছুক্ষণ এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করলাম, চ্যাঙস্পা থেকে নিচের দিকে মেইন বাজারের দিকে গেলাম, এখানে জামিয়া মসজিদের সামনে আগের দিনও এসেছিলাম, আজকে অনেক খানই সময় কাটানো গেলো। এক বুড়ির কাছ থেকে কিছু পাকা এপ্রিকট কিনলাম, তুরতুকের সেই স্বাদ ভুলতে পারিনি। রাজকুমার সিংহের কথা মনে পড়লো, উনি যেখানেই যেতেন বই কিনতেন বা বইয়ের দোকানে ঢু মারতেন। আমরাও বেশ কিছু বই কিনে ফেললামঃ রুদিয়ার্ড কিপ্লিং এর কিম, হারম্যান হেসের একটা, সেভেন ইয়ারস ইন তিব্বত, লিটল প্রিন্স ইত্যাদি। বইয়ের দোকান টা দারুণ বলতেই হবে। ঢাকায় এর ধারে কাছেও কিছু দেখি না।

আরেকটা তিব্বতি মার্কেট পাওয়া গেলো চ্যাঙস্পার কাছেই, এইখানে এক তিব্বতি দোকানদার ডাক্তার কে দেখে বলেই ফেললো, "তুমি বাংলাদেশী!" ডাক্তার কে সবাই নর্থ-ইস্টার্নের লোক ভাবে, নয়ত জাপানি, আমরা খুবই অবাক হলাম। লোকটার নাম ছাম্বা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতে প্রশিক্ষিত তিব্বতি গেরিলা দলের সদস্য - মুক্তিযোদ্ধা। মিজোরাম দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, এবং খাগড়াছড়ি রাঙ্গামাটিতে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, ভাগ্যিস আমি "ফ্যান্টম অফ চিটাগাং"  এর এই যোদ্ধাদের কথা আগেই পড়েছিলাম। জুম্মল্যান্ডের বাসিন্দা ডাক্তারকে চিনতে ছাম্বার কোন ভুল হয় নি। ছাম্বা আমাদেরকে বেশ কিছু এনটিক তিব্বতি জিনিষের সন্ধান দিল, সাথে চিনিয়ে দিলও কিভাবে নেপালী বা চিনা দ্রব্য চিনতে হবে । আমাদের সাথে বেশ ভাব হয়ে গেলো। অনেকটা সময় নানা রকম কথা বার্তা হলো।

ফ্যান্টম অফ চিটাগাং


রুমির কাছে তিব্বতের গল্প শুনেছিলাম। রুমি নেপাল সীমান্ত দিয়ে স্পেশ্যাল পাস নিয়ে তিব্বতে ঢুকেছিল, লাসা পর্যন্ত যেতে পেরেছিল। বেশিরভাগ জায়গায় কাশ্মীরের মতন চিনা মেশিনগান আর তার সামনে সর্বদা মাথা নিচু করতে হাঁটতে হয় তিব্বতিদের। পৃথিবীর সবখানেই স্বাধীনচেতা মানুষ কে দাবিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্র তার গোলাবারুদ নিয়ে হাজির, আমাদের জুম্মল্যান্ড, ভারতে কাশ্মীর, ঝাড়খণ্ড বা নাগাল্যান্ড, পাকিস্তানে বেলুচ বা সিন্ধুদেশ।  


দুপুরের খাবার সারলাম জি-ক্যাফে নামের একটা দোকানে, খাবারের মধ্যে কেমন একটা তেলাপোকা ধরণের গন্ধ ছিল। খুব একটা পছন্দ হলো না, যদিও তাদের এখানে প্রচুর সাদা চামড়ার আনাগোনা, তবে ওদের বসার জায়গাটা চমৎকার। একটু বিরক্তি নিয়ে বের হলাম। আজকে ইউরোকাপের ফাইনাল, ফ্রান্স বনাম পর্তুগাল। বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টে রাতে খেলা দেখার জন্য ব্যাবস্থা আছে। বাইরে প্রজেক্টর ইত্যাদি সহ নানান রকমের অফার।

দুপুর হয়ে গেছে। ডাক্তারের ইচ্ছে হলো মোটর বাইক নিয়ে লেহ ঘুরবে। চাইতে একটা ভাড়া করার জায়গাও পেয়ে গেলাম। ডাক্তার সাহস করে ট্রায়াল দিয়ে ফেলল। কিন্তু প্রচণ্ড ভারী। এর আগে সে খাগড়াছড়িতে রেগুলার চালিয়েছে, কিন্তু সেগুলি স্কুটার ছিল, আইম নিজেও পাগানে থাকার সময় একদিন চালিয়েছিলাম ইজিবাইক, কিন্তু দুইজনেরই সাহস কুলালো না। আমরা বেশ আয়েশ করেই সময়টা কাটাচ্ছিলাম। আজকে ছুটির দিন, রবিবার। সাপ্তাহিক প্রার্থনা বা পূজার সময় হবে, মেইন বাজারের মধ্যে একটা বৌদ্ধ মন্দির, সেখানে দারুণ ভিড়, এই প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দাড়িয়ে-বসে-ছাতা ধরে  অচেনা ঈশ্বরের কাছে অর্বাচীন মন্ত্রাবলি আওড়াচ্ছে লোকজন সব, সাদা চামড়ার কয়েকজন আগ্রহ ভরে আবার সেগুলির ছবি তুলছে।    

এক জায়গায় দেখলাম এক লোক বানরের খেলা দেখাচ্ছে, মন্দিরের মতন সেখানেও বেশ ভিড়। বানর কে কিম্ভুত কিমাকার পোশাক পড়িয়ে মানুষ ঠকানোর খেলা। কিছু লামাও বসে ভিক্ষা করছে, পাশেই মসজিদ। লাদাখে আমরা ঈদ টের পাইনি। তুরতুক বা উন্ডারের মুসলিম দেরও ছোট ঈদ নিয়ে তেমন কিছু করতে দেখিনি ।    

আমরা একটা ট্যাক্সি নিলাম, শান্তি স্তুপা। উদেশ্য বিকেলটা সেখানেই কাটানো। শান্তি স্তুপা চ্যাঙস্পা থেকে খুব কাছে। জাপান এর আর্থিক সহায়তায় নির্মিত। থিকসে বা সেমোর মতন প্রবেশ ফি নাই। একটা পাহাড়ের উপরে,  চ্যাঙস্পা থেকে হেঁটেও উঠা যায়, আমরা হেঁটে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম।  স্তুপার বাইরেই একটা চমৎকার ক্যাফে। আমরা কিছুক্ষণ হালকা চা ইত্যাদি নিয়ে সময় কাটিয়ে দিলাম। এখান থেকে সমগ্র লেহ দেখতে পাওয়া যায়, পিছনে খারদুংলা, আরেকদিকে সিন্ধুর নীল রেখা, বিধৌত উপত্যকা, বিমানবন্দরটাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। ক্যাফেতে একটা নর্থ-ইস্টের ছেলের সাথে পরিচিত হলাম, সে দার্জিলিং এ কিছুদিন ছিল, বাংলা বোঝে। পাহাড় বেঁয়ে উপরে নিচে নেমে ফিটনেস প্রাকটিস করছিল।

নামার সময় বেশ সাবধানতা নিতে হলো। পাঁচশর বেশি সিঁড়ি, ৩০০ মিটারের কম হবে না উচ্চতা, থেমে থেমে নামছিলাম, একটা অস্ট্রেলিয়ান ছেলের সাথে দেখা হলো, বাবা কোলকাতার মা সিডনীর, বাংলা বলতে পারে না,  দৈহিক গড়নও মায়ের জাতের। সে তর তর করে উঠে গেলো। আমরা নেমে এসে বেশ খানিক ক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। সন্ধ্যার দিকে খুঁজে খুঁজে একটা নন-ভেজ দোকান বের করলাম, এপল অর্চারড রেস্টুরেন্ট, জায়গাটা ভালোই, মশার উপদ্রব ছিল, আমরা অনেক দিন পর টিক্কা, কাবাব, নান-রুটি খেলাম, এখানেও একটা নর্থ ইস্টের ছেলে, দার্জিলিং এর।      


রাতে লারদাকে ফিরে, জুলে দিদি কে বিদায় দিলাম, ডাক্তার জুলেদিদি আর বাসার সবার জন্য গিফট দিল। লারদাকের আতিথেয়তা দারুণ ছিল। লাকিকেও এ কয়দিনে আসলে ভালোবেসে ফেলেছি। এর মধ্যে জানলাম, লাকির মা এবং তার বেশ কয়েকটা ছোট ভাই আছে, তাদেরকেও কুই কুই করতে দেখলাম। জুলে দিদি সকালের জন্য ট্যাক্সি বলে দিয়েছেন, ভোর সাড়ে চারটার সময় থাকবে গেটের সামনে।

রাতে আমার ঘুম ভালোই হলো, ডাক্তার আজকেও ভালো ঘুমোতে পারলো না। হাঁপানির আক্রমণ। মাঝ রাতে একবার ঘুম ভেঙ্গে গেলো, মনে হলো গ্যালারির মধ্যে আছি। ফ্রান্স-পর্তুগাল ম্যাচের গ্যালারির হই চই। লেহর নিস্তব্ধ রাতে, সম্ভবত উঁচু আওয়াজের সাউন্ড স্পীকারে খেলা সম্প্রচার করছে। এখানে পর্যটক ইউরোপের বেশি, তাই ফুটবলের কদর। খেলা শেষে অনেক রাতে লোকজন ফিরছে, কুকুর গুলির সম্মিলিত সুরধ্বনিও চলছে সমানে।

ভোরে উঠে দেখি ট্যাক্সি হাজির, জুলে দিদি এই সকাল বেলা আমাদের জন্য উঠলেন, ব্যাগ এগিয়ে দিলেন। ১০ মিনিটের মধ্যেই আমরা বিমান বন্দরে পৌছে গেলাম। গিয়ে দেখি গেট বন্ধ, পাঁচটার আগে খুলবেনা। আমাদের মতন অনেকেই দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির ভয় পাচ্ছিলাম, কিছুক্ষণ পর ঢোকা গেলো। লেহ বিমানবন্দরে পরতে পরতে সিকিউরিটি, বার বার লাগেজ ও বডি চেক। অন্তত চারবার। সামরিক বিমানবন্দর বলেই বোধ হয় এই ব্যাবস্থা। ভোরের আলো ফুটছে, স্তোক কাঙড়ির চুড়ায় আলো ফুটছে। শেষ রাতের ঘুমন্ত লেহ । বিমান উড়তে বেশি সময় নিলো না,  উঠেই লাদাখ রেঞ্জের পর্বতগুলির মাথায়, নিচে মুনল্যান্ড, চাঁদের পাহাড়গুলির মতন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত জেগে ছিলাম। ঘুম থেকে উঠলাম ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্ট, দিল্লি।