Thursday, September 01, 2016

প্যাঙগঙ সো

ত্রিশ

ডাক্তার থ্রিইডিয়টস ম্যুভির ফ্যান। আমি এখনো সেটা দেখে উঠতে পারিনি, দেখার সম্ভাবনা কম। তবে মানুষজনের কল্যাণে রাঞ্চোর (প্রোটাগনিস্ট) এর নাম জানা। সম্ভবত লাদাখ আমি সিনেমায় দেখি প্রথম মনি রত্নম/শাহ রুখ খানের "দিল সে" তে, তবে "থ্রিইডিয়টস" যেভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছে তার তুলনা নেই। প্যাঙগঙ অনেকের কাছেই থ্রি ইডিয়টস লেক, এইখানে  লেকের ধারে প্রায় ১২ খানা রাঞ্চোর ক্যাফে। ডাক্তারের প্রথমটা দেখে ধারণা হয়েছিল, ঐখানেই হয়তো আমির খান শুটিং এর ফাঁকে খানা খেয়েছিল, কিন্তু ভেতরে বসে আসে পাশে তাকিয়ে দেখে সবই রাঞ্চোর ক্যাফে।  ক্যাফের রান্না খুব একটা পদের না।  ডিমের সাথে রসুন দেয়া ভাতভাজি খাচ্ছিলাম। সস্তা অবশ্য। নামগিয়াল একটা কোকাকোলা নিল।  দোকানটা অস্থায়ী। সবকিছু বাইরে থেকে আনা,  এরা কেউ স্থানীয় না, আসলে প্যাঙগঙ এর আশে পাশে স্থানীয় গ্রাম বলে কিছু নেই। এই সব অস্থায়ী এবং পর্যটন ব্যাবসা কেন্দ্রিক। আমরা খাচ্ছিলাম, আর আমাদের সাথেই বিহারী বড় একটা দল। নিম্ন  মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য মনে হলো সবাই, এক দিনের ট্যুরে লেহ থেকে এসেছে। ভোরে রওনা দিয়ে দুপুরের মধ্যে প্যাঙগঙ পৌঁছানো যায়, প্যাঙগঙ এ লেকের ধারে হাঁটাহাটি আর ছবি তোলা ছাড়া কিছু করারও নেই। এখন ঘণ্টা দুইতিন পার করে খাওয়া দাওয়া সেরে আবার লেহ ফেরত যেতে সন্ধ্যা হবে। এই জায়গাটার নাম লুকুঙ।

আমরা খেয়ে দেয়ে বের হয়ে রুমি-মেইরের দেখা পেলাম। তারা হালকা খেলো, নিজেদের আনা শুকনো খাবার দাবার। তারা বেশ মজা পেয়ে গেছে। মেইরের জন্য ইসরায়েলের বাইরে তুরতুক ছিল প্রথম গ্রামে রাত্রিযাপন। এখানে ওদের দেখতে পেয়ে একটা বড় ভারতীয় পরিবারের সবাই ওদের সাথে ছবি তুলেছে একে একে। ওরা এতে খুবই অপ্রস্তুত এবং বিদেশীদের সাথে এভাবে সবাই ছবি তোলার দার্শনিক-নৃতাত্বিক কারণ সন্ধান করছে।

রুমি মেইরের সাথে আলাপে ডেড সীর গল্প শুনেছিলাম, মেইরের মতে প্যাঙগঙ এর ধারটা খুবই রোমান্টিক এবং ডেড সীর সাথে তুলনীয়। রুমির মতে এটা আরো বেশি সুন্দর। খাওয়ার পর্ব সেরে আমরা আবার জিপে উঠলাম, গন্তব্য স্প্যাংমিক, লেকের ধার ধরে আরো ভিতরে, চীন সীমান্ত অর্থাৎ পূর্ব দিকে। আমরা গুইলিওর কাছ থেকে পদ্মা গেস্ট হাউজের কথা শুনেছিলাম। খুঁজেও পাওয়া গেলো। ওদের তাবুও আছে, ডাক্তার এক লাফে তাঁবুতে ঢুকে সেখানেই থাকবে বলে লাফালাফি শুরু করে দিল, রুমি-মেইর অন্য দিকে জায়গা খুঁজতে চলে গেলো। এখানে গরম জল ও সংযুক্ত টয়লেট নেই।

একটু পরেই ডাক্তারের উত্সাহেও ভাটা পড়লো। লেকের জল ছুঁয়ে আসা প্রচন্ড বাতাসে এই ভর দুপুরেই শীত শীত লাগছে, তাঁবুর বেড়ার কাপড় ভেদ করে আরো ফাঁক ফোকড় দিয়ে বাতাসের তোড় দেখে ডাক্তার দমে গেছে। এরই মধ্যে ৪৩০০ মিটার উচ্চতায় অক্সিজেনের অভাব টের পাওয়া যাচ্ছে।  পদ্মার একটা লেকের দিকে জানালাওলা রুমে উঠে পড়লাম। ছোট্ট রুম, আরো কয়েকটা রুম আছে একই পদের, দুইটা ডরমেটরি রুম, ওগুলির ভাড়া কম, খাওয়া-দাওয়া এখানেই মিলে, সস্তাই মনে হলো, গেস্ট হাউজের পাশের একটা তাঁবুতে কিচেন।  বাতাস বেশ হালকা, শ্বাস নেবার সময় টের পাচ্ছি, ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে, আগামী কাল সকালে তাড়া নেই, চাইলে ঘুমিয়ে নেয়া যায়, কিন্তু নির্ঘুম গতরাতের কথা মনে করে আর সাহস হলো না।

কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। এরপর আরাম করে এক কাপ চা খেয়ে, বিকেলে টা লেকের ধারে কাটাবো বলে বের হলাম। অল্প নামতে হলো, এর মধ্যে মানুষ জন ধীরে ধীরে লেকের পাড়ে জড়ো হতে শুরু করেছে। লেকের পানি বেশ স্বচ্ছ। অল্প কিছু গাংচিল উড়তে দেখা গেলো। লেকটা লম্বালম্বি ১৩০ কিলোমিটারের মতন, চওড়া তেমন না। এখানে বড়জোর তিন কিলোমিটারের মতন হবে। ওপারে খয়েরি-বাদামি পাহাড়, আকাশ পরিষ্কার বলে এখন দারুণ নীল। দুপুরে জলের মধ্যে পাহাড়ের ছায়ায় বাদামী রঙের ছিল। শুনেছি একই দিনের মদয়ে চার বার রঙ পাল্টায় । আর শীতের দিনে জমে বরফ। লেকের জল লবণাক্ত।  

প্যাঙগঙ লেকের বিকেল টা খুব সুন্দর। আমরা কিছু ছবি টবি তুলে আর সৈকতে পাথরের উপরে বসে বসে বাকী বেলা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম, একেবারে সন্ধ্যার দিকে দেখা হলো রুমি-মেইরের সাথে। ওরা আমাদের কে খুঁজতে তাঁবু গুলিতে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল। ওদের সাথে কিছুক্ষণ কাটানো গেলো। সন্ধ্যা হয়ে এলে আমরা যে যার গেস্ট হাউজের পথ ধরলাম। নামগিয়াল খালিগায়ে শুধু জাঙ্গিয়া পরে তার বন্ধুকে সাথে নিয়ে সৈকতের উপর দিয়ে জিপ নিয়ে ঘুরাঘুরি করছিল। আমাদের দেখে লজ্জিত হলো বেশ। আমরা পরের দিন ১০ টার দিকে আসতে বলে  দিলাম। নামগিয়ালের মেজাজ ভালো আছে।


পদ্মা গেস্ট হাউজে আমরা ছাড়া একটা ভারতীয় দল, আর একটা মঙ্গোলয়েড চেহারার দল (প্রথমে ভেবেছিলাম চৈনিক, কিন্তু চীনা, পাকিস্তানী, বার্মিজ এরকম কয়েকটা দেশের নাগরিকদের পারমিট দেয় না)। উন্ডার আর  প্যাঙগঙ এর জন্য পারমিট ছাড়াও আলাদা টিকেট কিনতে হয় তবে সেটা সস্তাই। সন্ধ্যার পর তাঁবু গুলিতে আলো জলে উঠলো। যথারীতি সন্ধ্যা হয় বেশ দেরী করে, নীল আকাশ, নীল জল আর তাঁবুগুলির রঙিন আলো। বেশ উপভোগ করছিলাম। মঙ্গলয়েড দলটা এর মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিচ্ছে। আমরা রাতের খাবার খেতে গেলাম, চাওমিন, ভাত, সবজি, ডাল, আচার এবং শেষে চা-কফি।

আজকে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য হাত কান নাকমুখ সব ঢেকে নিলাম। গতরাতে ঘুম হয় নি, এক খানা এলার্জির ওষুধ খেয়ে নিলাম, ঠাণ্ডা-এলার্জি থেকেও বাঁচা যাবে, ঘুমেরও সুবিধা হবে। আমি খুব দ্রুতই ঘুমের গভীরে চলে গেলাম। হঠাত ঘুম ভাঙতে দেখি ডাক্তার ঘুমোতে পারছে না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর এত উচ্চতায় অক্সিজেনের অভাব ছিল, হাঁপানির সমস্যা হচ্ছে। কোনোমতে বাকী রাতটা কাটানো গেলো।


একত্রিশ

ভোরের দিকে ঘুম ভেঙ্গেছিল। উঠে দেখি "আলো ক্রমে আসিতেছে" - পাহাড়গুলি এখনো ঘুমিয়ে, নীলাভ আকাশ ও হ্রদ। আরেকটু গড়িয়ে নিয়ে উঠে দেখি আকাশে মেঘ, হ্রদের বুক চকচকে রূপালী, সূর্য উঠে গেছে ততক্ষণে। লেকের বিপরীত দিকে তুষার শুভ্র পর্বত শৃঙ্গ । আমরা চাপাতি-আলুরদম দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম, চাকফি সেরে বাইরে এসে দেখি মেঘ কেটে যাচ্ছে।  আমাদের কর্ত্রীর বয়স চল্লিশের মতন। একটা ফুটফুটে বাচ্চা আছে। গরম জল বালতি ভরে পাওয়া যায়, উনার রান্নাও মোটামুটি সুস্বাদু।

পদ্মা গেস্ট হাউজের দেয়ালগুলি বেশ পুরু, পাথরের তৈরি। জানালার ফ্রেম কাঠের। শীতের সময় শুনেছি এখানটা সব বরফে ঢাকা থাকে। লেকের আশে পাশে কোথাও কোন বসতি নেই আসলে। এগুলি জা দেখা যাচ্ছে সব পর্যটন কেন্দ্রিক। খাবার-দাবার ইত্যাদি বাইরে থেকে আসে, অস্থায়ী, স্থানীয় লোক বলে কেউ নাই, টাং স্টের আগে কোনো গ্রামও নেই। লেকে খুব বেশি মাছ আছে বলেও মনে হলো না, গাংচিলের সংখ্যা নগণ্য, অন্য কোন পাখি নেই। লেকে একটা সেনাবাহিনীর পেট্রোল বোট কে চড়তে দেখেছিলাম গতকাল, এছাড়া আর কোন নৌকা বা কিচ্ছুটি নেই। এখান থেকে লেকের  পার ঘেঁষে যেতে থাকলে  চুশুল সীমান্ত।


ব্যাগ  ইত্যাদি সব গুছিয়ে আরেকবার হ্রদের ধারে যাওয়া গেলো, ততক্ষণে মেঘ কেটে আবার সব নীল। দারুণ এক খেলা, আমরা আরো কিছু ছবি তুলে আর হৃদটাকে শেষবারের মতন কাছ থেকে দেখে নিলাম। দশটার মতন বেজে যাচ্ছে। নামগিয়ালের দেখা পাওয়া গেলো। আমরা রওনা হলাম। রুমি-মেইরের গেস্ট হাউজ থেকে ওদের তুলে নিলাম। ওদের দুদিন ধরেই রাতের ঘুম ভালো হচ্ছে না। এর আগে রাত দিয়ে রক্তপাত হচ্ছিল, এখনো তেমন সুস্থ না। ডাক্তারও একটু পরিশ্রান্ত, আমরা দ্রুতই রওনা হলাম। এর মধ্যে প্যাঙগঙ আবার সাদা/রুপালি হতে ধরেছে। লুকুং এর কাছে পৌঁছে, শেষ বিদায়ের জন্য তাকিয়ে দেখি আবার নীলাভ! বিদায় প্যাঙগঙ!


ফেরার পথে আগের দিনের উপত্যকা গুলিতে আবারো অনেক ভেড়া-ছাগল চড়তে দেখা গেলো। আমরা খুব দ্রুতই দুরবুক পৌঁছে গেলাম, এখানে তেমাথার আরেক মাথা যেটি চ্যাঙ লা হয়ে লেহর দিকে গেছে সেটি ধরা গেলো। প্যাঙগঙ ছিল ৪৩০০ মিটার উঁচুতে, এর মধ্যে আর উচ্চতা কমার কোন লক্ষণ নেই, আমারও একটু একটু মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে। আর এই চ্যাঙ ভ্যালীতে  প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। চ্যাং লার উচ্চতা ৫৩০০ মিটার। দুর্বুক থেকে সোজা উপরের দিকেই উঠে গেছে।

এই রুক্ষ মরুপর্বতে এদিকটার শুরুতে বেশ অন্যরকমের কিছু বেগুনী ও গোলাপি ফুল খেয়াল করলাম। ভীতির ব্যাপার হলো এই রাস্তায় প্রচুর দুর্ঘটনার আলামত। এখানে ওখানে খাদের মধ্যে ছোট-বড় নানা রকম গাড়ি চুরমার হয়ে পড়ে আছে। রাস্তা ভয়ানক, বাতাসে প্রচণ্ড শীতলতা, এক জায়গায় দেখলাম একটা ছোটখাটো লেকের মতন জমে বরফ হয়ে আছে, পর্যটকেরা তাতে মনে সুখে হাঁটাহাঁটি করছে। খারদুংলার মতন তুষারপাত না হলেও এখানে বাতাস খুব বেশি। চ্যাঙ লাতে খুব বেশি সময় কেউই থাকতে চাইলাম না। খারদুংলা যদি পৃথিবীর সর্বোচ্চ গিরিখাত (মোটর চলে এমন)  হয় এটি তৃতীয়। নামগিয়ালকে খুব সাবধানে চালাতে বললাম।

এর পরের বিরতি জিংরাল, একটা সেনা ক্যাম্প ১৪ কিমি দূরে, চ্যাঙ লা থেকে নামলেই, এপাশে রাস্তা আরো ভয়ানক, আরও বেশি দুর্ঘটনার আলামত। জিংরাল এ আমরা দেখলাম হিমাচল এর কিছু স্কুল বাস, হয়ত মানালি বা কেলং থেকে ঘুরতে এসেছে স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে। বেশ কিছু পাহাড়ি কুকুর দেখা গেলো, স্বভাবে নিরীহ কিন্তু ভয়ংকর দর্শন, আমার লাকির কথা মনে পড়ে গেলো, আজকে আবার দেখা হবে।

জিংরাল পর্যন্ত রাস্তা দুধর্ষ ও পেঁচানো। ডাক্তার এর মধ্যে জোজিলার চেয়ে এটিকে গুরুতর বলে মেনে নিয়েছে। এর পরের রাস্তা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগল। এখন আমরা যাচ্ছি শক্তি গ্রামের পথে। রাস্তা উপত্যকার মধ্যে দিয়ে। খুব বেশি চড়াই-উতরাই নেই। চিমেরার কাছে বেশ কিছু নতুন ঘরবাড়ি তৈরি হতে দেখলাম। পাথরের ঘেরাও দিয়ে তার মধ্যে কাঠের ফ্রেম বসানো হচ্ছে। এক জায়গায় দেখলাম, লাদাখিরা একটা পার্ক মতন জায়গায় বনভোজন করছে, সাধারণ মানুষজন, পাতলা প্লাস্টিকের থালা-গ্লাশ দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। শক্তি গ্রামটা বেশ বড়ো। একটা বড় গুম্ফা আছে,  বরাবরের মতন সাধারণের বাড়িঘরের থেকে উপরে পাহাড়ের গায়ে, প্রভুত্বকারী।


কারুর কাছে এসে আবার সিন্ধুর দেখা পেলাম, এখানে সিন্ধু বেশ খরস্রোতা ও আকারে বড়। কারুতে দুপুরের খাবার স্থির হলো। আমরা কিছু ফল কিনলাম, মেইর অনেকগুলি কিনলো। পেঁপে, তরমুজ, আপেল, পিয়ার, ইত্যাদি। মম আর ফ্রাইড রাইছ। এটা আরেকটা তেমাথা বা টি জংশনের মতন। একটা দিয়ে আমরা এলাম, যাব লেহর দিকে, আরেকটা মানালি থেকে এসেছে রোটাঙ-কেলঙ ইত্যাদি হয়ে। এখান থেকে হেমিসের রাস্তা অনতিদূরেই।

এর পর থেকে রাস্তা দারুণ। নামগিয়াল সমান রাস্তা পেয়ে প্রায় লাফাতে শুরু করল। আমরা অবশ্য সাবধান করে দিলাম। খুব বেশি রাস্তাও না আসলে। একটু পরেই স্তোক কাঙরির দেখা পাওয়া গেলো, থিকসে গুম্ফার পাশ দিয়ে লেহর দিকে ছুটলাম। আমাদের চারদিনের সফর শেষ।

জিপের সাইড গ্লাসে লেহ উপত্যকা