Thursday, September 01, 2016

হিমালয় হতে হিমালয়

ঊনত্রিশ
স্কুরুর পরে উন্ডারের আগ পর্যন্ত বেশ বড় আকারের সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনী মোতায়েন আছে, শিয়াচেন এর সাথে এখান থেকেই যোগাযোগ হয়। একটা সামরিক এয়ারপোর্টও চোখে পড়েছিল। মেইরের নাক দিয়ে রক্তপাত হচ্ছিল, আমি আর ডাক্তার ওকে মেডিক্যাল সেন্টারের দিকে নিয়ে যাবার কথা বললাম, খুব বেশি পাত্তা দিল না ।   হিমালয় গেস্ট হাউজে পৌঁছানোর পর বেলা বেশ বাকি ছিল। নামগিয়াল চলে যাবার পর আমরা ব্যাগ ইত্যাদি রেখে স্নান ইত্যাদি সেরে নিলাম। একটা সুন্দর সবজি বাগান এখানেও। ওয়াইফাই পাওয়া গেলো, দুর্বল কিন্তু কাজ চলে। গেস্ট হাউজের লোকেরা বেশ অতিথি বৎসল। চা-ইত্যাদি পাওয়া গেলো চাইতেই। আমরা আসার পর ২ টার মতন ছোট গাড়ি আর মোটর বাইকে একটা দম্পতি আর চারজনের একটা দল এলো। আমি আর ডাক্তার বিকেলটা এক পাঁক হেটে আসলাম পাশের গ্রাম থেকে।

এখানে গ্রামটা সুন্দর । সমতল উপত্যকা, তার মাঝে উন্ডার।  আশেপাশের বাড়িগুলির বেশির ভাগ হয় গেস্ট হাউজ নয়ত তার নির্মান চলছে। আমাদেরকে রাস্তায় দেখে আশে পাশের বাচ্চারা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল, এখানে অল্প কিছু মুসলিম পরিবার আছে, কিন্তু বেশির ভাগই বালতি না, লাদাখি। গেস্ট হাউজে ফিরে এলাম, নামগিয়ালের দেখা নেই, জিপটাও সাথে নিয়ে গেছে, আজকে সারাদিন তার আচার-ব্যবহার অদ্ভুত ছিল, তার বাড়ি পানামিক এখান থেকে কাছেই, সেদিকেই গেলো না তো?

গেস্ট হাউজের লোকদের সাথে কথা হলো, আমাদের আগামীকালের গন্তব্য প্যাঙগঙ।  লেহ থেকে প্যাঙগঙ যাবার পথ এদিকে না, ওটা মানালির পথে খানিকটা গিয়ে চ্যাঙ লা হয়ে। কিন্তু সে পথে যেতে হলে, আমাদের খারদুংলা হয়ে লেহ ফিরে সেই পথ ধরতে হবে, এবং তার জন্য দিন দুয়েক প্রয়োজন। এখানে শয়কের পার ধরে খালসার পর্যন্ত পরশুদিনের পথ, এর পরে খারদুং এর দিকে না গিয়ে আগম এর পথে, সেই পথ শয়ক হয়ে লেহ-মানালি আর প্যাঙগঙ এর রাস্তার সাথে মিলেছে এক জায়গায়। মুশকিল হলো আগমের পরের অনেকটা পথ শয়কের তীর ঘেঁষে। ব্লগে পড়েছি এই রাস্তায়  সময় কম কিন্তু রাস্তা অতো তৈয়ার নয়।  স্থানে স্থানে ঝর্না চলে গেছে এবং পর্বতের বরফ গলে গলে দিন বাড়ার সাথে সাথে সে জলের উচ্চতাও বাড়তে থাকে। শয়কও দুধার ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যত ভোরে রওনা দেয়া যায় ততই মঙ্গল।

গেস্ট হাউজের লোকদের জিজ্ঞেস করে জানা গেলো, সাধারণত লোকজন ৫ টার দিকে রওনা দেয়, যাতে বেলা বাড়ার আগেই  শয়ক পার হওয়া যায়। আমরা প্রমাদ গুনলাম, নামগিয়াল ৮ টা বলে কোথায় গেলো? তার মোবাইল নম্বরটাও নেই যে ফোন করে বলবো আসতে জলদি করে। কি আর করার এখন! রাতের খাবার খেয়ে নিলাম, চাপাতি-ডাল ইত্যাদি। কফি খাওয়ার কারণে কিংবা নামগিয়ালের দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুমে সমস্যা হলো। শুয়ে পড়েছিলাম আগে আগেই, এক প্রস্থ ঘুম হবার পর জেগে দেখি মাত্র এগারোটা বাজে। ডাক্তার ঘুমে বিভোর, আমি যতই চেষ্টা করি তন্দ্রাও আসে না। অনেক কুস্তাকুস্তির পর ভোরের আগে একটু ঘুম হলো, টেনশনে সকাল-সকাল উঠে গেলাম।      

সকালের নাস্তা ইংলিশ। আমরা উঠার আগে আগে সত্যিই বাকিরা চলে গেছে। নামগিয়ালের হাতেই ছেড়ে দিলাম ভাগ্য। সে অবশ্য আর দেরী করলো না। আজকে তার হাসি দেখে একটু ভালো লাগছিল, কালকের মেজাজ দূর হয়েছে জনাবের। দু-মিনিটের মধ্যে নামগিয়াল নাস্তা করে নীল। আমরা প্রস্তুতই ছিলাম। যাত্রা হলো শুরু। একটু পরেই মৈত্রেয়র সাথে শেষ দেখা হয়ে গেলো। নুব্রা উপত্যকা বেঁয়ে খালসার চলে এলাম। এখানে এসে একটু জান ফিরে এলো, আরেকটা জিপের সন্ধান পেলাম, ইসরায়েলি মেয়েগুলি যাদেরকে লেহতে গ্লোবাল ট্যুরিজমের অফিসে দেখেছিলাম। ঠিক হলো দুই গাড়ি এক সাথে যাবে, তাতে বিপদ আপদে সুবিধা। বিপদ একটাই রাস্তার উপর নদী চলে আসতে পারে। এখান থেকে প্রায় একশ কিলো মিটার রাস্তা প্রায় জনশূন্য। গ্রাম মাত্র ২ টা: আগম আর শয়ক।

পার্বত্য রাস্তা, উপত্যকা ধুসর। নুব্রার মতন সবুজ না, তুরতুকের মতন সংকীর্ণ না, আবার খারদুং এর পথের মতন গিরিখাত নেই। নদী ভীষণ খরস্রোতা। কোথাও কোথাও সত্যিই রাস্তার উপরে চলে আসছে। রাস্তা দু'তিন স্থানে পাথরের মাঝে হারিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। এর মধ্যে দেখি কোথা থেকে সাইকেল আরোহীরা রেসের পোশাক পড়ে সাইকেল চালাচ্ছে। তাদের উদ্যম থেকে নিজের মধ্যেই উদ্যম ফিরে এলো। এক জায়গায় শয়কের উপরে একটা ব্রিজ পার হতে এক ঝাঁক মোটর সাইকেল আরোহীর দেখা পেলাম। পাশেই রাস্তার নির্মান কর্মীদের একটা তাঁবু। মোটর সাইকেল আরোহীরা বয়সে যুবক। একজন বাঙ্গালি, থাকে পশ্চিমে। তার বন্ধুদের মতে বাঙ্গালি সবখানে পাওয়া যাবে।

নির্মান কর্মীরা বেশিরভাগ বিহার বা উড়িষ্যা থেকে,  হিন্দু সমাজের নিচু জাতের লোক, গরীব, রাস্তার ধারেই দুধর্ষ তাদের থাকার ব্যাবস্থা! এক টুকরা পলিথিন মোড়ানো, ওটার নামই তাঁবু। আশে পাশে চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটারে হয়ত নেই কোন গ্রাম, ফলের গাছ, কিংবা একটু খানি সবুজ। উচ্চতার কারণে বাতাসে অক্সিজেন অপ্রতুল। এই কষ্টকর জায়গাগুলিতে বহু বহু বছর আগে থেকে বিহার-উড়িষ্যা বা দক্ষিণ ভারতের লোকগুলি শ্রমদাস হয়ে পাচার হয়ে এসেছে বহু প্রাচীন আমল থেকে, প্রগতির ভারতেও এর অন্যথা নেই। বার্মার সেগুনের বনে, মালয়ের রাবার বনে, শ্রীহট্টের চাবাগানে। এগুলি দিয়েই নাকি সভ্যতার উন্নতি!


আমাদের ঠিক সামনেই একটা জিপের পিছনে চে গুয়েভারার স্টিকার, আগেও বেশ কয়েক জায়গায় দেখেছিলাম, এবারে রুমি-মেইরের চোখে পড়লো। তারা যেন আঁতকে উঠেছে। আশ্বস্ত করতে আমি নামগিয়ালকে জিজ্ঞেস করলাম, এই স্টিকারের মর্ম, তার উত্তর, "দিখনেমে আচ্ছা হ্যাঁয়!" হ্যাঁ বেশ একটা বিপ্লবী নায়ক চেহারা বটে। নামগিয়ালের সাথে আরেকটু আলাপ হলো, তার ভাই সেনাবাহিনীতে চাকরি করে। সে নিজে তেমন লেখাপড়া করে নি, সারা বছর জিপ চালায়। নামগিয়ালকে এই তিন দিনের মধ্যে খাওয়া দাওয়া করতে খুব বেশি দেখলাম না, সেধে আমাদের সাথে আনা কিছু বাদাম-চকলেট-কেক দিয়েছিলাম, সেগুলি অবশ্য নিয়েছিল। মাঝে মাঝে বিড়ি ফুঁকে আর সারাদিন গান শুনছে অবিরাম, বেশির ভাগ বলিউডের হিন্দি গান, "সুইমিংপুলে স্নানের পর সুস্বাদু হয়ে যাওয়া প্রেমিকার জন্য" দরদি গায়ক হানি সিং এর গান এর ভক্ত। মেইরও এক পর্যায়ে নামগিয়ালের গানগুলির কপি পেতে চাইল।        

মেইর-রুমি দম্পতি হিসেবে খারাপ না, মাঝে মাঝে ঝগড়া করে, আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাদের ছেলেমেয়েরা বিয়েশাদি করে ফেলেছে। মেইর ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে চাকরি করত। কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছে বা কজনকে মেরেছে এই ধরণের প্রশ্ন থেকে বিরত থাকলাম। তবে জেরুসালেম নিয়ে তার ভালোবাসা আছে, তবে তেল আবিব বেশি পছন্দ কারণ ওটা অনেক বেশি ইউরোপীয় ঢং এর। এরা র এর উচ্চারণ করে না, ফলে "রুমি" আসলে "হ্রুমি"। আরবের সংখ্যা ইসরায়েলে কম নয়, তাদের প্রতি ঘৃণা আছে এমন মনে হলো না। আমাদের আসলাম আর মেন্দি সাফেদির কাহিনী মনে পড়ে গেলো। রাজনীতি ভীষণ ব্যাপার!  মেইরের কাছ থেকে জানা গেলো "মাদ্রাসা" শব্দটার অর্থ হিব্রু আর আরবিতে একই। আরো কিছু হিব্রু শব্দ শেখার চেষ্টা চালালাম।

শয়কের কাছে রাস্তায় থামতে হয়েছিল। আমরা সমানে রাস্তাঘাটে মূত্র বিসর্জন করে যাচ্ছি। অনেক জল খাওয়া হচ্ছে, রাস্তার দুধারেই সুন্দর সব বুনো ফুল। বুনো ফুল না বলে মরু ফুল বলা যায়। একটা এমেরিকান ইহুদি তার বাচ্চাদের আর্চারি শেখাচ্ছে। আমরা আর খুব বেশি সময় থামলাম না এখানে।

লেহ থেকে বের হবার পর, এই দুদিনের প্রত্যেক দিনেই দিগন্ত বদলাচ্ছে। এর মধ্যে আজকের দিনটি দুর্দান্ত! পথভয়ের সাথে এই দুর্দান্ত শয়কের পার ঘেঁষে শৃঙ্গ রাজি আর গন্তব্যে প্যাঙগঙ এর হাতছানি সব মিলে বেশ। শয়ক থেকে দুর্বুক মাত্র  ১৬ কিলোমিটারের মতন রাস্তা, সময়ও খুব বেশি লাগে না। এই কদিনে সব মিলে এই রাস্তা টুকুই আমার কাছে সবচেয়ে বিপজ্জনক মনে হলো। ডাক্তার এখনো জোজিলার ভয়ের কথা ভুলতে পারেনি। এখানে আচমকা  রাস্তা উপরের দিকে উঠে গেলো, এর পরে এক পাশে ভয়ানক খাদ, নিচে সবুজাভ-ভীষণ খরস্রোতা শয়ক, দুধারে বাদামী পর্বত। রাস্তা বেশ আঁকাবাঁকা এবং চড়াই-উতরাই সম্পন্ন।


দুর্বুকের কাছে এসে বুঝলাম বিপদ কেটেছে। শয়ক দেখলাম এক জায়গায় বেশ নিস্তরঙ্গ, আর একটু পরেই প্রচণ্ড ভয়াল স্রোতে পাথর ভেঙ্গে ছুটেছে। দুর্বুক একটা তেমাথা। একটা দিয়ে আমরা এলাম, এখন যাচ্ছি প্যাঙগঙ এর দিকে, আরেকটা রাস্তা লেহর দিকে। দুরবুকের পর আমরা শয়ক কে বিদায় দিয়ে প্যাঙগঙ লেক রোডে উঠে এলাম। ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠছি, কিন্তু ভ্যালি দেখে খুব বেশি বোঝার উপায় নেই। এখানে উচ্চতা চার হাজার মিটারের মতন। একটা গ্রাম থেকে কিছু জলের বোতল কেনা হলো, এর পরে নাকি জলের বোতলের দামও বেশি। আসলে এর পরে প্যাঙগঙ পর্যন্ত আর কোন গ্রাম নেই। ঐ পাশে চীন সীমান্ত, চুশুল। একদিনের ব্যাবধানে পাকিস্তান থেকে চীনের সীমান্তে।

পথের উপত্যকাগুলি দারুণ সুন্দর। ভেড়া-ছাগল-গরু চড়ে বেড়াচ্ছে। ঘোড়া বা খচ্চর দেখা যায় শুধু সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের আশে পাশে। একটা জায়গায় নামগিয়ালের এক বন্ধুর জিপের সাথে দেখা হলো, সে থামিয়ে কিছু শুকনো এপ্রিকট বিনিময় করলো। আমরাও ভাগ পেলাম। পথ আবার একটু উঁচুতে উঠতে লাগলো, মধ্যে একটা মিনি প্যাঙগঙ এর দেখা পেলাম। ওটার নাম ছাগার। শেষ আরেকটা পর্বতে উঠতেই আবার পর্যটকের দেখা পেলাম। খালসার থেকে দুর্বুক পর্যন্ত রাস্তায় পর্যটক খুব কম ছিল, উলটা  দিক থেকে কোন গাড়িই চোখে পড়েনি। এ পাশে ভালই পর্যটক এর আনাগোনা। এ পাহাড়ে উঠেই এক ঝলক নীল দিগন্তের দেখা মিলোলো। বহু কাঙ্ক্ষিত প্যাঙগঙ!