Saturday, July 23, 2016

বার্লি, গম, এপ্রিকট, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান

ছাব্বিশ

ভোরেই ঘুম ভাঙলো। ব্যাগ ইত্যাদি গোছানো ছিল, সবশুদ্ধ একবারে নিচে নেমে গেলাম, হাতমুখ ধুয়ে বের হবো। লাকির ভয়েই এই ব্যবস্থা। তবু রক্ষা নেই, উনি এই সাত সকালেই এসে চাটাচাটি শুরু করতে চান। কর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম, লাকি ঘুমায় না? গ্লোবাল এক্সপ্লোরার এসে নামগিয়ালকে পাওয়া গেলো। সে বলে তোমাদের জিপ তো নেই, খিল খিল, ভুল জিপে তুলে দেবার ভান করলো, খিল খিল। সবই তার বাজে কৌতুকের চেষ্টা! শেষমেশ আমাদের জিপ পাওয়া গেলো। ড্রাইভার কে জিজ্ঞেস করলাম, কোনদিকে বসলে ভালো ভিউ হবে। সে ভাঙা হিন্দিতে বললো, "অভি বায়ে। " ড্রাইভারের নামও নামগিয়াল। কিন্তু এ হাসে না, খিল খিল তো দূরের কথা, তবে বয়স কম, সুদর্শন। ইংরেজি তেমন বুঝে না। আমাদের আপাতত লক্ষ্য হোটেল থেকে ইসরায়েলি দম্পতি রূমি-মেইর কে তুলে নেয়া। রাস্তা চ্যাঙসপা থেকে শান্তি স্তুপের দিকে গিয়ে ডানের দিকে।

হোটেল গিয়ে দেখি তারা প্রস্তুত। কফির মগ নিয়ে গাড়িতে উঠলো। সামনের সিটে আমি, ডানে ড্রাইভার, মাঝে ডাক্তার ও ওরা দুইজন। বসার ব্যবস্থায় উভয় দলই খুশি। পিছনের সিটগুলিতে আমাদের ব্যাগ।চারজন হওয়ায় ভালোই হলো, নয়তো ব্যাগগুলি ছাদে যেত আর একেবারে পিছনে বসাটা কতটা আরামদায়ক হতো সেও নিশ্চিত না।  এখন থেকে রাস্তা সোজা উঠে যাবে খারদুংলার দিকে।লেহ থেকে খারদুংলা মাত্র ৩৯ কিলোমিটার।দেড়-দু ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। লেহর ৩৫০০ মিটার থেকে ৫৬০০ মিটার। লাদাখের ছাদ বলা যায়। এর মধ্যে রূমী-মেইরের সাথে পরিচয় ইত্যাদি হওয়া গেলো।একটা ঝামেলা, নামগিয়াল তেমন ইংরেজি বোঝেনা, সবকিছু আমাকে ভায়া করে, কি জ্বালা!

গাড়ি একটু উপরে উঠতেই একটা সোনালী ডানার ঈগল দেখা গেলো, রূমির মত এটা দেখতে অনেকটা কন্ডোরের মতন। ছবি তুলতে তুলতে হাওয়া। খারদুংলার পৃথিবীর সর্বোচ্চ গিরিপথ গুলির একটা, অনায়াসে মোটরগাড়ির চলে এমন ধরলে সর্বোচ্চ, এখানকার লোকজন সেভাবেই বিজ্ঞাপন দেয়, অন্তত ডাক্তারও সে কারণেই টিশার্ট পরে তৈয়ার। রূমীর মতে বলিভিয়া সর্বোচ্চ।আপাতত মেনে নিলাম, কিন্তু রুমি টিটিকাকা পৃথিবীর সর্বোচ্চ লেক বলেছিলো, ওটা ভুল। রুমি ইসরায়েলে শিক্ষক, বায়োলজি পড়ায়। বয়স ৫০ এর উপরে। ইংরেজি ভালো বলে, এর মধ্যে তার দেখা হয়ে গেছে  পৃথিবীর অনেক দেশ,  অারহেন্তিনা, চিলি,  পেরু (পেহু ), বলিভিয়া, মায়ানমার, নেপাল, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, তিব্বত, অন্ত নেই। অামি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এগুলি বলে একটু ভাব নিলাম।

রুমি নিজে ইন্ডিয়া এসেছে বেশ কয়েকবার, এই প্রথম মেইর সঙ্গ দিচ্ছে।  ডাক্তারের মন্তব্য এরা হয় বিবাহিত নয়, বা সদ্য বিবাহিত, হানিমুনে এসেছে। আমার কিছুই মনে হলো না।  এর মধ্যে দু'দল নিজেদের ভাষায় আর ইংরেজিতে পরস্পরের সাথে কথা বলে চলেছি। এই দুজনের ছবি তোলার বেশ শখ।  ডাক্তারও খুব খুশি তাতে।জায়গায় জায়গায় থামবে, অনেক ছবি তোলা যাবে। তবে আপাতত দুশ্চিন্তা এই খারদুংলা।ব্লগে পড়েছিলাম এখানে ১৫ মিনিটের বেশি থাকা যাবে না কোনোভাবেই। এত উচ্চতায় বেশিক্ষণ থাকলে এএমএস আক্রান্ত হতে হবে নির্ঘাত। আরেক ব্লগে পড়েছিলাম, এক গ্রূপ সাথে করে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে গিয়েছিলো, গ্লোবাল এক্সপ্লোরারের নামগিয়াল কে সে কথা বলে সে খিল খিল করে উড়িয়ে দিয়েছিলো।
   

আমরা যে পথে চলেছি এটি প্রাচীন সিল্করুটের অংশ। বহুকাল আগে এই রাস্তা ধরেই সিল্করুটের কাফেলা খারদুংলা পার হয়ে নুব্রা ও বালতিস্তান হয়ে দিয়ে মধ্য এশিয়ার পথ ধরতো। এখন সে রুট আর নেই, কিন্তু তার অংশাবশেষ রয়ে গেছে। খারদুংলা থেকে ১৫ কিলোমিটার মতন আগে একটা মিলিটারি পোস্ট। নাম সাউথপুল্লু।এই পর্যন্ত রাস্তা বেশ ভালো ছিল, আমরা লেহ শহর কে নিচে রেখে উপরে উঠে আসছি। রাস্তা থেকে লেহ আর শান্তি স্তুপা বেশ স্পষ্ট দৃশ্যমান। এরই মাঝে কিছু সাইক্লিস্ট আর মোটর বাইক এর দল চোখে পড়লো। শ্রীনগর লেহর রাস্তায় এরা তেমন ছিল না। এখানে সংখ্যাটা ভালোই। বেশ একটু অসূয়া হয় এদের দেখলে। পিছনে তেলের কন্টেইনার, আর ব্যাগ বোঁচকা বেঁধে দলে দলে ছুটেছে। কখনো একা, কখনো দুজন, কখনো পিছনে প্রেমিকা বা স্ত্রী। দুর্গম গিরি - কান্তার মরু লাদাখ মোটর সাইকেল আরোহীদের জন্য স্বর্গ (bikers' paradise)!

রাস্তা খুবই সরু. ধূসর পাহাড়, তার গায়ে বেগুনি জংলী ফুল। উপরের দিকে তুষার শুভ্র শৃঙ্গ, আজকে ঐ শৃঙ্গ ছুঁয়ে তারও উপর দিয়ে ঐ পাশের পৃথিবীতে যাবো আমরা। গিরিপথ গুলি দারুন, একটা বোরো পর্বতের গা বেয়ে উঠে তার ওপারের দুনিয়াতে যেতে হয়, সেখানে ভিন্ন দিগন্ত, একই আকাশ কিছু পাহাড়ের রং বদলে যায়, মানুষ বদলে যায়, ফুলের রং বদলে যায়। এপাশে এত উপরেও কয়েকটা কাক উড়ছিল।খুবই অদ্ভুত লাগলো কাকেদের এই উচ্চতায় অভিযোজন করতে দেখে। মাথা ব্যাথা একটু একটু শুরু হচ্ছে, ঠান্ডাও বাড়ছে বেশ। সাউথ পুল্লুর পর রাস্তা আর আগের মতন ভালো না, তবে জোজিলার মতন অতো  খারাপও না, তবে ভয়ানক উঁচুতে। এখানেও রাস্তার মেরামত চলছে। সকালের সূর্য লাদাখ রেঞ্জের উপর পড়ছে আর আমরা প্রায় একই উচ্চতা থেকে রুপালি উজ্জ্বল শৃঙ্গ গুলিকে দেখছি। লেহ এখনো দৃশ্যমান।

একটু একটু ভয় হচ্ছে, এএমএস এর জন্য। আমি জানি এই খারদুংলা পর হতে পারলে সামনের দুদিনে প্যাঙগঙ আগে পর্যন্ত আর চিন্তা নেই উচ্চতা নিয়ে। দেখতে দেখতে আমরা তুষার শুভ্র যে উপত্যকা আর শৃঙ্গটা দেখছিলাম তারও উপরে উঠে গেলাম। জিপ থেকে নেমে শিহরিত হয়ে গেলাম। বরফ পড়তে শুরু করেছে এরই মধ্যে। আমরা চার জনেই প্রচন্ড খুশি। কিন্তু দারুন ঠান্ডা। আমার আর ডাক্তারের জীবনে প্রথম তুষারপাত।হালকা মিহি দানার মতন পড়ছে বরফ। একে তো এই উচ্চতা, তার উপর বরফ, সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য এখনই বলা যাচ্ছে না। আকাশ একটু মেঘলা। রাস্তার ধারে বরফের বড় বড় চাঁই, গত শীত কালের এখনো গলে শেষ হয় নি। কিছুক্ষনের মধ্যেই খারদুংলা চলে এলো, একেবারে উপরে! পামিরের কথা পড়েছিলাম বই তে ছোটবেলায়, পৃথিবীর ছাদ, খারদুংলা লাদাখের ছাদ - কোনো সন্দেহ নেই। বরফ পড়ছে, এর মধ্যে আমরা দ্রুত এদিক ওদিক কিছু ছবি তুলে ফেললাম, একটা ক্যাফে, আর একটা শিব মন্দির, সেখানে নমঃ শিবায় জাতীয় অদ্ভুত ভক্তি সংগীত বাজছে উচ্চগ্রামে। ভুতুড়ে না হলেও অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার। সুভেনির শপ ও মিউজিয়াম পাওয়া গেলো, আমি আর ডাক্তার এই উচ্চতম স্থানে তলপেট খালি করলাম।

প্রেয়ার ফ্ল্যাগ আর সোয়াস্তিকার ছড়াছড়ি। খারদুংলার পর উৎরাই শুরু। এতক্ষণ ছিল চড়াই। একটা জায়গায় রাস্তার ধারে বেশ বরফ জমে আছে, ডাক্তার নেমে বরফ হাত দিয়ে ধরে দেখলো। এখানেও একটা নাম:শিবায়! খারদুংলা পার হতেই আকাশ একটু একটু করে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।  সৌভাগ্যই বলতে হয়, অল্প মাথা ব্যাথা, প্রচন্ড শীতল  বাতাস এর ঝাপটা অার হালকা শ্বাসকষ্টের উপর দিয়ে খারদুংলা পার করা গেল। এখন নিচের দিকে নামবে। অামরা বেশ অানন্দিত।ড্রাইভার নামগিয়ালকে ধন্যবাদ দিলাম, সাবধানে চলার জন্য।  উপর থেকে লেহ দেখার পর মনে হলো, না জানি এই দুধর্ষ গিরিপথ, উপত্যকা, শহর, মালভুমি শীত মৌসুমে দেখতে কেমন! ছবিতে দেখেছি, বাস্তবে দেখার সাধ হলো খুব। নামগিয়ালের বাড়ি নুব্রাতে, পানামিক। পানামিকে বেশ কিছু উষ্ণ প্রস্রবণ আছে, ছোট্ট গ্রামের মতন, ট্যুরিস্ট খুব বেশি যায় না। শীতে কি করে জিজ্ঞেস করায়, বললো, লোকাল প্যাসেঞ্জার আনা নেয়া করে! নামগিয়াল খুবই মৃদু ও অল্প ভাষী। আমাদের শান্তিদির উল্টা। আহ ঐদিন বিদায় না জানিয়েই চলে আসতে হলো, এত কিছুর পরও বাঙালি পরিবারটিকে ভুলিনি আর খানিকটা সমীহও করি, পুরি-কাশি-দার্জিলিং থেকে দূরের এই দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছেন, উনাদের সমীহ না করলে আমাদের সমীহ করবে কে?


ধীরে ধীরে নেমে এলাম এদিকের মিলিটারি পোস্টে। নাম নর্থ পুল্লু। মিলিটারি পোস্টগুলিতে পারমিটের কপি দিতে হয়, নামগিয়েল দৌড়ে গিয়ে দিতে দিতে আমরা সকালের নাস্তা সেরে নিলাম, এখানে থুকপা।  আগের চেয়ে ভালো, থুকপার শোক কিছু হলেও কাটলো। এখানে আমরা আরেকটা বাংলাদেশি দলের দেখা পেলাম, পরিচিত হবার সুযোগ পেলাম না, দুই দম্পতি আর তাদের একটা করে বাচ্চা, ছয়জনের দল, ছেলেটা খেতে চাইছে না, মা জোর করে খাওয়াচ্ছে, এই দূর লাদাখে এসেও! বাচ্চাগুলিকে সুস্থ দেখে আমাদেরও বেশ আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো, মাথা ব্যাথা কমতে শুরু করেছে। এর মধ্যে আমরা প্রতিদিন এসিমক্স খাচ্ছি দু'বেলা, এখন জিপে বসে প্রচুর পরিমানে পানি, একটু পর পর চকোলেট ইত্যাদি।

রুমি-মেইর বোতলের ভিতর লেবু দিয়ে কি একটা শরবত বানিয়ে নিয়েছে, আর তাই খাচ্ছে। ওরা পানি খাচ্ছে আমাদের দ্বিগুন। প্রসাবের হারও অনুরূপ। তাতে থামা হয়, ফটো তোলা হয়, বিশ্রাম হয়, ঝামেলা শুধু প্রতিবার আমি দোভাষী। রুমি  অবশ্য জানালো বলিভিয়াতে তার কোন সমস্যা হয় নি উচ্চতার জন্য।নিচে নামার পর রাস্তা ভালো হয়ে গেলো। ব্লগে পড়েছিলাম এ রাস্তায় হিমালয়ান মারমট দেখতে পাওয়া যায়, অামরা অবশ্য পাহাড়ের গায়ে কিছু ছাগল চড়তে দেখলাম।  নর্থ পুল্লুর আশপাশটা দারুন সুন্দর।খারদুংলা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে, উচ্চতা ষোলো হাজার ফুট।এর পরের গ্রাম খারদুং, উচ্চতা ১৪৭৩০, এর পর ধীরে ধীরে পাহাড় ঘুরে নামতে থাকবে। খারদুং এর কাছে একটা দারুন সুন্দর পাহাড়ি ঝর্ণা পাওয়া গেলো।

খারদুং এর পর থেকে দৃশ্যপটে আমূল পরিবর্তন, সবুজ ম্রিয়মান এবং গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মতন, চারপাশ, লাল-কমলা পাহাড়, মাঝে কোনো প্রাচীন নদী বয়ে গিয়ে গভীর খাদ তৈরী করেছে বলে মনে হচ্ছে। কদাচিৎ একটা মালভুমি বা উপত্যকা, আবার গিরিখাত। নদীও দেখতে পাওয়া গেলো। এখানে পাহাড়ের গায়ে লাল আর কালো কালো ধাতব প্রলেপ। মেইর বললো এগুলি আয়রন আর কপার। পাহাড় থেকে নামার আগে নিচে একটা সবুজ গ্রাম চোখে পড়ল, খালসার। গেইম অফ থ্রোনস এর খালিসির কথা মনে পড়লো। যায় হোক, পাহাড় থেকে নামার সাথে সাথে শুরু হলো শয়ক(shoyk) নদী। এই ডানের ভ্যালিটার নাম শয়ক উপত্যকা। এই নদী টা এখন থেকে বাম দিক থেকে পাহাড়ের ঘা ঘেঁষে ঘেঁষে এসেছে।খানিক দূরে ডিস্কিতের কাছে নুব্রা আর শয়কের মিলন স্থল। ওখান থেকে আরম্ভ নুব্রা ভ্যালি, নুব্রা নদী এসেছে উত্তরে শিয়াচেন থেকে। আর শয়ক এসেছে আরেকটু পশ্চিমের একটা হিমবাহ থেকে তুর্তুক হয়ে পাহাড়ের গাঁ ঘেঁষে ঘেঁষে। বলে রাখা ভালো, আমরা এ পর্যন্ত সবগুলি নদীর উজান পানে এসেছি।  ডিস্কিট থেকে নুব্রা আর শয়ক মিলে শয়ক নামেই ভাটির দিকে গিয়ে মিশেছে সিন্ধুর সাথে।

খালসার থেকে একটা রাস্তা নুব্রার পাশ ধরে গেছে তির্কিট, পানামিকের দিকে, নামগিয়ালের বাড়ি। আমরা যাচ্ছি বায়ে, পশ্চিমের দিকে, ডিস্কিট-উন্ডার হয়ে তুর্তুকের পথে। শয়ক এর ধারের রাস্তায় নামতেই নামগিয়ালের এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো উল্টো দিক থেকে আসা এক জিপে।  কিছুক্ষণ বিরতি নেয়া গেলো। ডাক্তার একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল।এখানে নেমে একটু ফ্রেস হয়ে ঘুম তাড়ানো হলো।   নুব্রা ভ্যালি তে ডিস্কিট-উন্ডার সবচেয়ে বড় দুটা গ্রাম। উন্ডার মোটামুটি শহরের মতন। ডিস্কিটে আজকে থামার পরিকল্পনা নেই, লাঞ্চ করা যেত, কিন্তু রূমি-মেইরের একবারে থেমে খাবারের ইচ্ছা। আমি আর ডাক্তার ক্ষুধার্ত ছিলাম। আপাতত বাদাম-চকোলেট-বিস্কিটে কাজ সারতে হচ্ছে। এ জায়গাটা দারুন সুন্দর। ভ্যালিটা অনেক বড়। মরুভূমির পাশেই বিশাল সবুজের সমারোহ। যদিও আগামীকাল আবার এখানে আসা হবে তবু থেমে ছবি তোলার লোভ সামলানো গেলো না, দারুন পরিষ্কার আকাশ, পাহাড় আর সেই আকাশের প্রতিচ্ছবি নিচের জমিনে।

আবার যাত্রা শুরু, একেবারেই বালিয়াড়ি, মোটামুটি বড়ই লম্বায়, ডিস্কিট থেকে উন্ডার পর্যন্ত গোটা টাই বালিয়াড়ি, শয়কের তীর ঘেঁষে, কাঁটাঝোপের বন।  খালসারের আগে শয়কের পাশে বেশ কিছু ক্যাম্পিং সাইট আর, র্যাফটিং সাইট দেখেছিলাম। ডিস্কিটেও ক্যাম্পিং সাইট দেখা যাচ্ছে। শয়কের জল, সিন্ধুর মতন নীল না, রুপালি, বালু মিশে এই দশা, স্রোত সিন্ধুর মতনই। ডিস্কিটের কাছে বালিয়াড়ির উপর এটিভি (all terrain vehicle) চড়ে বেড়াচ্ছে পর্যটকেরা।  উন্ডারের পথ কাঁটাঝোপের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। আমাদের এর পরের বিরতি স্কুরু।উদ্দেশ্য ছিল চা। কিন্তু দোকানি নেই।

স্কুরুতে একটা ছোট্ট দোকান, মালিকের ছেলে বসে, দোকানে বিস্কিট, কোমল পানীয়, ম্যাগি দেখা যাচ্ছে। ঝর্ণার শীতল পানি জমিয়ে ওটা চৌবাচ্চার মতন করে তাতে কোমল পানীয়ের বোতল জমিয়ে রেখেছে। দোকানের নাম "অনপো", জোরে বলিউডের হিন্দি গান বাজছে। পাশেই একটা স্রোতোস্বিনী ঝর্ণা  পাহাড় থেকে টগবগিয়ে নেমে এসে শয়কে পড়েছে। একটা গুম্ফা। পাশে একটা লাইব্রেরি। কিছু শ্রমিক বিশ্রাম নিচ্ছিল। বড় একটা প্রেয়ার হুইল ঘুরিয়ে দিয়েছে। যতক্ষণ ঘুরবে ততক্ষন বিশ্রাম। বেশ অভিনব পন্থা।  একটা আর্মি ভ্যান এসে থামলো। কয়েকটা বাচ্চা নেমে গেলো, এরা স্কুল থেকে ফিরছে, স্কুলও আর্মি পরিচালিত। হালকা নীল শার্ট আর গাঢ় নীল প্যান্ট।  


এখানে কারাকোরাম রেঞ্জের পাশ ধরে চলেছি আমরা। পাথুরে উপত্যকা। দুপাশে কাটা ঝোপ, জংলী ফুল অথবা শুধুই পাথর। দিগন্তে কারাকোরামের তুষার শৃঙ্গগুলি। রাস্তায় কোনো ভারতীয় পর্যটক নেই, সব সাদা চামড়া। শয়কের তীর ধরে চলা শুরু হলো। দুপুরের রোদে ধূসর পাহাড়ে পরিচিকা, সাদা পর্বত চূড়ার দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। বোগদাঙ নামের একটা গ্রাম এলো। প্রথম বালতি গ্রাম। মুসলিম বেশিরভাগ। শয়কের ধারেই। গম-বার্লির খেত, এপ্রিকটের বাগান, লম্বাটে। তুরতুক আর বিশ কিলোমিটারের মতন। শয়কের উপর দুইটা কাঠের ব্রিজ পার হতে হলো. এখানে বেশ কিছু মিলিটারি ক্যাম্প।  ভারী সেনা মোতায়েন, পাক নিয়ন্ত্রণ রেখা খুব কাছেই। একটা ক্যাম্পের নাম, "ম্যাগনিফিসিয়েন্ট সেভেন", আরেকটা "ফেরোসাস ফাইভ" ইত্যাদি। বেশ কয়েক স্থানে যুদ্ধে নিহতদের জন্য স্মারক স্তম্ভ এবং বিজয় স্তম্ভ।

লাদাখের রাস্তার মেরামত ও নির্মাণের দায়িত্ব বর্ডার রোড অর্গানাইজেশনের, এরা রাস্তায় সাবধানে চালানোর জন্য অনেক সতর্ক বাণী দিয়ে রেখেছে। কয়েকটা বেশ মজার ও তাৎপর্যপূর্ণ: Dont be a gamma, in the land of lamma, Darling I like you, but not so fast, Feel the curves, but do not test them, Be Mr Late, than Late Mr, After Whisky, driving risky, If you are married, divorce speed, Life is short, dont make it shorter, ... এরকম অনেকগুলি। আমাদের নামগিয়াল কতটুকু পড়ছে কে জানে, আমরা জেগেই রইলাম। কিন্তু এই রাস্তার শেষ কোথায়? মনে হচ্ছে ভারত নয়, পৃথিবীর শেষ মাথার দিকে চলেছি, কারাকোরামের ভয়ানক সব খাদ, পাথুরে পৃথিবী, ম্যাড ম্যাক্স ফিউরি রোডের মতন , চলছে তো চলছেই। কালো কুচকুচে কোথাও কোথাও শয়কের ধারা, সুরিয়েল ছবির মতোন। এই শেষ বিশ কিলোমিটার একেবারেই রুক্ষ। এক দিকে গভীর খাদ, রাস্তা প্রস্তরাচ্ছন্ন, পাথর কালচে, লালচে, কোথাও কোথাও যেন দস্তা বা জিংকের প্রলেপ, মানুষ বা অন্য প্রাণীর বাঁচার কোন লক্ষণ নেই। কোথায় শেষ ?শেষ মাথায় সত্যি দেখি একটা গ্রাম, সুরিয়েল পটভূমিতে বাস্তব জীবন। ছবির মতন সুন্দর বলতে যা বোঝায়, গুইলিওর বর্ণনা সার্থক, আমাদের কল্পনাও - তুর্তুক!

তুর্তুক গ্রামটা দুই ভাগে ভাগ করা, মাঝে একটা প্রচন্ড খরস্রোতা ঝর্ণা।সারাক্ষন এমন শব্দ করছে, হঠাৎ শুনলে মনে হবে বুঝি মেশিনের শব্দ। সশব্দে শয়কে গিয়ে মিশেছে। গ্রামে ঢুকতেই এক গাদা বচ্চা ছেলে মেয়ে আমাদের ঘিরে ধরলো, টাকা, চকোলেট ইত্যাদির জন্য। একটু মন খারাপ হয়ে গেলো। এই বাচ্চাগুলির এভাবে "১০ রুপি" "চকলেট" সাইবার কথা নয়।  এ নিশ্চয়ই প্রজাতকদের আমদানি। যেমনটা দেখা যাচ্ছে বর্তমান সাজেক - এ.
যায় হোক, একটা ব্রিজ পার হয়ে ওপারে যেতে হবে।  বেশ উঁচু একটা পাহাড় , পাহাড়ের ওপরেই খুব সুন্দর সেই গ্রাম।