Friday, July 22, 2016

সারমেয় সমাচার

পঁচিশ

সাড়ে তিনহাজার মিটার উঁচুতে ঘুম ভালোই হলো, একটা ব্যাপার বাদ দিয়ে।লাকির ভয়ে ব্লাডার ফুল করে ঘুমিয়ে ছিলাম একবারে ভোরে যাবো বলে। শেষমেশ আর পারা গেলো না। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই আবার লাকি।  কোনোমতে না দৌড়ে টয়লেটের দরজা দিয়ে দিলাম। ফেরার সময় দেখি সে অন্য কোথাও ব্যস্ত। সে সুযোগে রুমে ফেরত আসলাম। লারদাক গেস্ট হাউজ টা তিনতলা, তিব্বতি কায়দার বাড়ি।টয়লেট আলাদা - নিচে নামতে হয়, এটাই একমাত্র অসুবিধা, কিন্তু খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমরা যে ঘরটাতে আছি তার দুই দিকে জানালা, ফলে ভোর থেকেই প্রচুর আলো আসতে থাকে। পাশের ঘরটা ওদের পারিবারিক প্রার্থনার ঘর। রুমের বাইরে একটা টেরেস, ওপাশে আরেকটা ঘর, ওটার তিন দিকে জানালা, আরো সুন্দর। এই দুটো ঘর থেকে স্তোক কাংড়ির শৃঙ্গ সরাসরি দৃশ্যমান। ভোরের আলোয় সে দৃশ্যে মন ভুলে যায় আগের রাতের সারমেয় ভীতি।

লারদাক গেস্টহাউজ এল শেপ। এল এর একটা হাতা দুই'তলা। আয়তক্ষেত্রের বাকি অংশে একটা বাগান।তাতে ফুল, সবজি, এপ্রিকট,পিয়ার ।বাড়িটার বায়ের দিকে আরেকটা বাগান, জলের ব্যবস্থা।এখানে দেখলাম সোলার প্যানেল বসানো, এক দিক দিয়ে ঠান্ডা জল ঢালতে থাকলে আরেক দিক দিয়ে তাৎক্ষণিক গরম পানি, ইস আমাদের বগালেক -কেওকারাডং বা রেমাক্রিতে এগুলি যদি বসানো যেত! পাশেই কাপড় ধোবার জায়গা। সকালে আটটা পর্যন্ত সরকার পানীয় জলের ব্যবস্থা করে আলাদা লাইনে, এর মধ্যে যার যা দরকার ভরে ফেলো। বাড়ির বাড়িটার সামনে একটু নিচে একটা ক্ষেত, শালগম, পালং, বকোচই ইত্যাদি। ক্ষেতের ওপাশে ওদের একটা পারিবারিক সমাধি স্তম্ভের মতন, সুন্দর ডিজাইন করা। ওপাশে আরেকটা গেট আছে। জুলে দিদি এ বাড়িতে কাজ করেন, পরিচারিকা, কিন্তু আমাদের দেশের মতন না, পরিবারের অন্য সব সদস্যদের মতন প্রায় সমান অধিকার ভোগ করেন। কর্তা-গিন্নি দুজনেই শিক্ষিত, তাদের কন্যা-পুত্র দিল্লিতে পড়াশোনা করে, গত শীতে জুলেদিদিও ওদের ওখান থেকে বেড়িয়ে এসেছেন। এখন মেয়েটা ছুটিতে লেহ তেই থাকছে।

সকালের নাস্তা হয়ে গেলো, পরোটা-ওমলেট আর জ্যাম দিয়ে। খাবার সময় আরেক দফা লাকির সাথে খেলা হলো। সে সম্ভবত আমাদের চিনতে চাইছে। কিন্তু এত সমাদর সহসাই আমি নিতে পারছি না। আজকে সারাদিন আমাদের কোন প্ল্যান নেই। মেইলে দেখলাম কবির-ইভান যুগল গতরাতে লেহ তে পৌঁছেছে, একটু অবাক হলাম, কারণ তাদের পেহেলগাম যাবার কথা ছিল আগের প্ল্যানে।যাই হোক, উনারা কাংড়ি নামের একটা হোটেলে উঠেছেন, সময় হলে আমাদের কে যেতে বলেছেন, তাতে প্যাঙগঙ এ একসাথে যাওয়ার প্ল্যান হতে পারে।ওনাদের হোটেল ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের পাশে, মানে চ্যাঙসপা থেকে নিচের দিকে গেলে পাবার কথা।

আমরা বের হয়ে আবার নামগিয়ালের কাছেই গেলাম।খিল খিল করে জানালো, এখনো কিছু হয় নি কিন্তু হয়ে যাবে। আমরা হাটা শুরু করলাম চ্যাঙসপার মূল রাস্তা ধরে, যেহেতে ঢালের উপর, হাঁটতে কষ্ট নেই। ভাবছিলাম আশেপাশের যেসব দর্শনীয় স্থান গুলি আছে, সেগুলি দেখা যায় কিনা। একজন বললো, বাইক নিয়ে ঘুরতে। আমাদের দুজনের বাইক চালানোর অভিজ্ঞতা খুবই কম। আমি সর্বসাকুল্যে এক দিন অর্ধেক বেলা ইলেকট্রিক বাইক চালিয়েছি, সেও তিনটিন বার ভূপতিত হয়ে, সমতলে। ডাক্তার অভিজ্ঞতর, কিন্তু সেও সবসময় চালিয়েছে স্কুটি। পাশেই একটা দোকান, বাইক ভাড়া দেয়, দোকানি ছেলেটার পায়ে বিশাল ব্যান্ডেজ, উপরন্তু একটা স্টিক দিয়ে বেঁধে দেয়া, ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ।আমি ভালোই দমে গেলাম। ডাক্তারের আগ্রহ আছে, ছেলেটা জানালো তার বাইকগুলি ঠিকঠাক নেই, সামনের দিকে এগুলে আরো দোকান পাওয়া যাবে।

ডেল্টা বলেছিলো, লেহ তে জল দুষ্প্রাপ্য, বোতলের দাম বেশি।এখনো পর্যন্ত পার লিটার বোতলের দাম বাড়েনি, তবে দোকানগুলিতে লক্ষ্য করলাম বোতল রিফিল করা যায় - ১০ টাকা। চ্যাঙসপার সব খানে ইউরোপীয়ান টুরিস্ট দের আনাগোনা। বেশিরভাগ আবার ইসরায়েলি।শুধু নামগিয়ালের দোকান না, আরো অনেক গুলিতে হিব্রু বিজ্ঞাপণ, এমনকি রেস্টুরেন্টে হাম্মাস, ফেলাফেল ইত্যাদি। এছাড়া জার্মান, কোরিয়ান, ইতালিয়ান সব রকমের রেস্টুরেন্টের আহ্বান, বার-বিয়ার হ্যাপি আউয়ার,  সাথে ইউরো কাপের খেলা দেখা ফ্রি। রাতে বড় পর্দায় খেলা সরাসরি প্রজেক্ট করে। ট্যুরিস্ট এজেন্সি দুই রকম, ট্রেক আর ট্যুর। সবাই তাদের দোকানের সামনে নুব্রা, প্যাঙগঙ, স্তোক কাংড়ি বা জংস্করের দারুণ সব লোভনীয় ফটোগ্রাফ দিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।

আরেকটা এজেন্সির কাছে গেলাম। চার-দিনের প্যাকেজ ওদেরও আছে, কিন্তু অগ্রিম চাইলো, আর খরচ একটু বেশি। একটা বাইক ভাড়ার দোকান পাওয়া গেলো। এবার ডাক্তার কে ঠেকায় কে।  দোকানি ট্রায়ালের জন্য পাশের খোলা একটা জায়গায় নিয়ে গেলো, এক রাউন্ড ঘুরে ডাক্তারের আগ্রহ কমে এলো, এই বাইক গুলি আকারে বিশাল, প্রচন্ড ভারী (স্কুটি/ইবাইক অনেক হালকা), গিয়ারের নানা ঝামেলা - প্রাণ ফিরে পেলাম। বাইক বাদ দিয়ে আরাম করে হেলে দুলে সামনে আগাতে লাগলাম। টাকা ভাঙাতে হবে, সাথে কবির ভাই -ইভান ভাই দের খোঁজ নেয়া দরকার। হাটতে ভালোই লাগছিলো।বেশ কিছু সুভেনির শপ, তিব্বতি মার্কেট, বুকশপও চোখে পড়লো। একটা স্কুল দেখলাম, খ্রিস্টান মিশনারি।বেশ প্রাণ চঞ্চল একটা শহর। শহরের প্রায় যে কোনো জায়গা থেকে পাহাড়ের উপরে, লেহ প্যালেস আর সেমো ফোর্ট দৃশ্যমান।

হোটেল কাংড়ি খুঁজে পাওয়া গেলো। উনারা দুজন নেই, পারমিটের জন্য বের হয়েছেন, আমরা একটা চিরকূট রেখে এলাম। ডাক্তার কাংড়ির টয়লেট ব্যবহার করে এসে প্রচন্ড বিরক্ত। আমরা বের হয়ে ঠিক করলাম, সময়টা কাজে লাগাই, আশেপাশের জায়গাগুলি আয়েশ করে ঘুরে আসা যায়। একটা ট্যাক্সির সাথে কথা হলো। ঠিকসে-সে-লেহপ্যালেস-সেমো ফোর্ট-শান্তি স্তুপা ট্যুর ঠিক করলাম, ওয়েটিং সহ চার্জ মাত্র ১৮০০ টাকা।বাস স্টপের কাছে দিয়ে সে অবশ্য পর্চা বদলে আমাদের অন্য এক ট্যাক্সিতে তুলে দিল, ড্রাইভারের নাম রিনচেন - কাশ্মীর জয়ী রিনচেন এর নামে। লেহ থেকে সমতলে নেমে আসলেই চোগলমসার, জায়গাটা মুসলিম অধ্যুষিত। দোকান পাট ইত্যাদি থেকে আরো প্রতীয়মান। এখন থেকে ডানে এযারপোর্ট হয়ে শ্রীনগর হাইওয়ে বায়ে থিকসে ইত্যাদি হয়ে মানালি হাইওয়ে। আমাদের প্রথম গন্তব্য থিকসে।  

থিকসে গুম্ফা দেখতে বেশ। উপরে উঠে যাওয়া যায় ট্যাক্সি নিয়ে। উপর থেকে লেহ শহর আর সিন্ধু উপত্যকার একটা ভিউ পাওয়া যায় বেশ। তোরণ টা সুন্দর। ঢুকেই বাম দিকে গাছ আর ফুলের ঝোপগুলি, তার ছায়ার নিচে সুন্দর বসার জায়গা। দুয়েক জনকে দেখলাম বেশ আরাম করছে। লেহ তে এই গরমে দিন ভালো হলে সূর্যের তাপ বেশ প্রখর। শীতের সময়ও কম থাকে না। একটা কথা বেশ প্রচলিত লেহ সম্বন্ধে সেটা হলো, " ... a man sitting in the sun with his feet in the shade suffer from sunstroke and frostbite at the same time!" এখানে ওঠার পর থেকে একটা কথা মনে হতে থাকলো। প্রাসাদ বা মন্দিরগুলি সব পাহাড়ের উপর, লাদাখ অঞ্চলে গুম্ফা প্রধান বা লামাদের দুর্নীতি বা ইত্যাদি নিয়ে রাহুল সাংকৃত্যায়ণের লেখায় বিস্তারিত আছে, আমরা ভাবছিলাম সামাজিক স্তরে এরা উপরে এবং ভৌত অবস্থানের দিক দিয়েও এরা পাহাড় বা টিলা ইত্যাদির উপর, যাতে নিচের সমতলে থাকা সাধারণ প্রজারা এদেরকে ঘাড় উঁচু করে দেখতে বাধ্য হয়, আনুগত্য আনতে সহায়ক। চিপাগলিতে বা ভিড়ের মধ্যে এদের অবস্থান নাই, উপাসনালয় বা প্রাসাদ কোনোদিনই  গণ প্রতিষ্ঠান ছিল না।


লাদাখ অঞ্চলের লামারা দুইজাতের: হলুদ টুপি আর লাল টুপি। থিকসে গুম্ফা ছয়শ বছরের পুরানো, হলুদ টুপীদের। মৈত্রেয় বুদ্ধের একটা তিনতলার সমান উঁচু মূর্তি। অনেক পর্যটক বসে নীরব ধ্যান করছে। জায়গাটা ভালোই, জানালা দিয়ে লাদাখ উপত্যকা দৃশ্যমান। পাশে একটা তারামন্দির, তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে আমার ধারণা খুবই অল্প ছিল, সিঙ্গাপুরে একটা মন্দির দেখে রীতিমতন ভয় পেয়ে গেছিলাম, এবারে ভয় পেলাম না, কেমন বীভৎস ও বিরক্তিকর লাগতে থাকলো।  রাহুলজীকে একটু উদ্ধৃত করি,

"দ্বিতীয় মন্দিরে দেমছোগ (যবয়ুম)- এ বীভৎস অশ্লীল কামওবাসনা উত্তেজক মূর্তি রয়েছে।মহাপ্রভু গৌতমের পবিত্র শিক্ষার কি হাল হয়েছে এদেশে। অাজীবন যিনি ইন্দ্রিয় সংযমের উপদেশ দিয়েছেন, এখানে তাঁরই নামে কি বীভৎস কান্ড চলছে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, মন্দিরের বাতাসও কলুষিত এবং অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।"  - আমার লাদাখ যাত্রা / রাহুল সাংকৃত্যায়ণ। 

থিকসের গুম্ফার ভিতরকার স্থাপত্য বা সজ্জাকৌশল সুন্দর। জায়গায় জায়গায় প্রদীপ জ্বালানো, আর ভক্তদের উপহার দেয়া সয়াবিন বা সূর্যমুখী তেলের বোতল। এগুলি হলো ভগবানের অনির্বান শিখায় ভক্তের আহুতি। যুগে যুগে এইসব অনির্বান শিখা জ্বালিয়ে রাখতে কত কত ভক্তের সর্বনাশ হয়েছে কে জানে!

অনেকগুলি প্রেয়ার হুইল। এগুলি হাত দিয়ে ঘোরানো যায়, একবার ঘোরালে ভিতরে যেসব মন্ত্র লিখে পুড়ে দেয়া আছে সেগুলি পাঠের পুন্যলাভ হয়। একটা তিব্বতি ঔষধের দোকান মতন আছে। নেমে আসলাম। রিনচেন আমার আর ডাক্তারের যুগল ছবি তুলে দিল বেশ কিছু।এখানে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, সব ড্রাইভার বা গাইডরা ক্যামেরা অপারেট করায় ওস্তাদ, নেপালে বা মায়ানমারে এরকম দেখিনি। ঠিকসে থেকে আমাদের পরের গন্তব্য সেয় প্যালেস।লেহ বা লাদাখের রাজার দ্বিতীয় বাসস্থান। যাবার পথে পড়লো আর্য অবলোকেতশ্বর গুম্ফা। এখানে অনেকগুলি সাদা সাদা ছোট ছোট বৌদ্ধ মন্দির  বা স্তুপার ধ্বংসাবশেষ।এগুলির কোনো কোনোটি হাজার বছরেরও পুরানো।মোট সংখ্যা ৭০০র মতন। ঠিক পাগানের স্তুপাগুলির মতন দেখতে। লাদাখের শুষ্ক-মরু আবহাওয়ায় বেশির ভাগই ক্ষয়ে গেছে।

এখান থেকে একটু পরেই সেয় প্রাসাদ। অনেক টা লেহ প্রাসাদের মতোই দেখতে, উঠার পথে অনেকগুলি প্রেয়ার হুইল। ডাক্তার উঠতে চাচ্ছিলো না, সে এরই মধ্যে কাহিল, আমার উৎসাহ দেখে একটা সাত পাথরের স্তুপ বানিয়ে তারপর উপরে গেলো।লাদাখের রাস্তায় প্রায়ই দেখা যায় এমন সাত - দশ - চৌদ্দ পাথেরের স্তুপ। তিব্বতিরা এগুলিকে কোনোকিছু শুরুর জন্য শুভ মনে করে। গুল পানাগ আর তার বন্ধু এমন অনেকগুলি করেছিল তাদের যাত্রায়। ডাক্তার মিস ইন্ডিয়াকে স্মরণ করলো। উপরে যাবার পথে আমরা একটা লাদাখি বর-যাত্রা যেতে দেখলাম, বাদ্য বাজিয়ে গাড়ি করেই যাচ্ছে। এখানে সিন্ধু অনেক কাছে, উপত্যকাটা অনেক সবুজ, একটা তৃণ ভূমি চোখে পড়লো।

প্রাসাদ টা রাজধানী লেহ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। প্রায় পাঁচশ বছরের  পুরানো। রাজা দেলদান নামগিয়ালের তৈরী।  গোটা প্রাসাদ টা তিনতলা। শাক্যমুনি বুদ্ধের একটা সাড়ে স্যাট মিটার উঁচু মূর্তি আছে। এখন আর কোনো জৌলুস অবশিষ্ট নাই। ব্রিটিশ রা লেহ আর সেয় লুঠ করে রাজ পরিবার কে স্তোক প্রাসাদে পাঠিয়ে (নির্বাসিত) দিয়েছিল। এখানে পাথর খোদাই করা বৌদ্ধ পট ও লিপি পাওয়া গেলো।  উপর থেকে স্তোক প্রাসাদ দৃশ্যমান। দুপুরের খাবারের জন্য আমরা নিচে নেমে এলাম।

সিন্ধুর পাড়েই রেস্টুরেন্ট, মমো আর ফ্রাইড রাইস। পাশে সিন্ধু থেকেই বের হওয়া একটা জলাভূমি, তাতে মাছ বড় বড়, রাজহাসঁ ইত্যাদি, পাশের তৃণভূমিতে, গরু-ছাগল-ভেড়া। স্থানে স্থানে লাল লাল জংলী ফুল, খুব সুন্দর।আমাদের দেশে ধনীরা এগুলিই টব বা বাগানে চাষ করার জন্য লক্ষ্য টাকা পর্যন্ত খরচ করে। লাদাখে সবখানে মমোর সাথে একটা স্যুপ দেয় আর চিলি পেস্ট এই দুই মিলে সিদ্ধ মমো বেশ উপাদেয়। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সেমো ফোর্ট। ডাক্তার এরই মধ্যে বেশ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে।সে আর রিনচেন গল্প করতে থাকলো। আমি একই বেরিয়ে আসলাম সেমো থেকে। রিনচেন এর প্রেমিকা থাকে দিল্লি, গত শীতে সে দিল্লিতে তার সাথেই ছিল। তার পরিবার বিবাহের আগে এই সম্পর্ক মানে কিনা জিজ্ঞেস করায় রিনচেনের উত্তর, "জানাতে যায় কে!"

সেমো দুর্গটা সুন্দর। আগেই বলেছিলাম, লেহর মোটামুটি সব জায়গা থেকেই সেমো দুর্গ দৃশ্যমান। একই ভাবে সেমো থেকে লেহর সব কিছু দেখা যায়। রাজা চাইলেই সবাইকে নজর বন্দি করে রাখতে পারতেন। সেমো ফোর্ট অনেক উঁচুতে আর বেশ সুন্দর।এখানেও মৈত্রেয় বুদ্ধের একটা ৮ মিটার উঁচু মূর্তি। মৈত্রেয় শাক্যমুনির পর পৃথিবীকে উদ্ধার করতে আসবেন, যখন মানুষ "ধর্ম" ভুলে যাবে। মৈত্রেয় বুদ্ধের সাথে ইসলাম এর ঈশা নবী / ইমাম মেহেদী কিংবা হিন্দুদের কল্কি দেবের কাহিনীর অনেক মিল। যদিও আহমাদিয়ারা মনে করে মির্জা গোলাম আহমাদ এবং বাহাই রা মনে করে বাহাউল্লাহই মৈত্রেয়। ঠিক-ভুল যাচাই করার উপায় নাই। ধর্মীয় ভবিষ্যৎ বাণীগুলি মেলানো বড় কঠিন। আগে জানলে এগুলি করা থেকে হয়তো বিরত থাকতেন প্রবক্তারা। কিন্তু এগুলি ছাড়া মানুষকে তালিবালি দেয়ার উপায়ই বা কি!

সেমোতে গেট কিপার লামা একটা ছেলে, দিন-দুপুরে ঢুলছিলো, আমার শব্দে ঘুম ভেঙে টাকার রশিদ মেলে ধরলো। সেমো দুর্গ লেহ থেকে অন্তত আড়াইশ মিটার মতন উঁচুতে। এখান থেকে একটা রাস্তা গেছে, নিচের দিকে লেহ প্যালেস। অনেক কেই লেহ প্যালেস থেকে হেঁটে উপরে চড়তে দেখলাম। আমার খুব ইচ্ছা হলো নিচের দিকে অন্তত নামি। ডাক্তারের কথা ভেবে সে যাত্রা বাদ দিলাম। সেমোতেও কালিমার ভয়াবহ সব মূর্তি।একেবারে উপরের প্রকোষ্ঠের বারান্দার রেলিং কাঠের, সেখানে এক লামা বসে আছে, আমি জুলে ইত্যাদি বলে তাকে পাশ কাটালাম।  স্তোক কাংড়ি, শান্তি স্তুপা আর লেহ শহরের কিছু দারুন ভিউ পাওয়া গেলো। নেমে চলে এলাম লেহ প্যালেসে। এখানে আমরা ভুলে বিদেশিদের টিকেট কেটে ফেলেছিলাম দুইশ টাকা করে, গেট কিপার আমাদের দেখে বাংলাদেশিদের জন্য টিকেট কাটতে বললো। সে টিকেটের দাম মাত্র ১৫ টাকা।

লেহ প্যালেস বাইরে থেকে দারুন, নয়তলা। লাদাখী প্রাসাদ বা বাড়িগুলি পাথরের তৈরী, একতলার উপর কাঠ দিয়ে এর উপর আরেক তলা, এমনি করে উপরে উঠে গেছে।বাস্তবিকই ভিতরে কিছু নেই, রাজ পরিবারের একটা পারিবারিক মন্দির পাওয়া গেলো, তার ভিতর কিছু প্রাচীন পুঁথি ইত্যাদি রক্ষিত আছে।  এছাড়া সবগুলি ঘর প্রায় শূন্য। ইন্ডিয়ান পর্যটকদের বেশ ভিড় এখানে, এদের জ্বালায় ডাক্তার কোনো ফটোই তুলতে পারলো না।  ডাক্তার ততক্ষণে মহা বিরক্ত ও বোধ করি ক্লান্ত। শান্তি স্তুপা আর গেলাম না। পথে টাকা ভাঙানোর জন্য মেইন বাজারের কাছে থামলাম। সকালে এক জায়গায় দেখেছিলাম ভালো রেট।  একটা মেয়ে বসে আছে, ডলার দেয়ার পর দেখা গেলো তার কাছে কিছু টাকা কম, অন্য এক জায়গা থেকে টাকা চাইলো, সেখানে কিছু একটা ঝাড়ি খেয়ে বললো, রেট বদলে গেছে ওটা সকালের রেট, বিরক্ত হলাম একটু, যাই হোক, শ্রীনগরের রেটেই পাওয়া গেলো।


গ্লোবাল এক্সপ্লোরার এ চলে আসলাম। নামগিয়াল এবং খিল খিল। পারমিট হয়ে গেছে।নামগিয়াল প্রায়ই বাজে ধরণের কৌতুক করার চেষ্টা করে, বেশির ভাগেই সে আগে থেকেই খিল খিল করতে শুরু করে।  আমরা বসে থাকতেই আরেকটা  গ্রূপ এলো নামগিয়ালের কাছে, তারাও ইসরায়েলি ইহুদি, তাদের সমস্যা ধর্মীয়, তারা নাইস (nice) লোক খুঁজছে জিপের সঙ্গী হিসেবে, আমাদের দিকে তাকানোর ভঙ্গিতে মনে হলো না আমরা নাইস গোত্রের লোক।  তাদের দ্বিতীয় সমস্যা, শুক্রবারের আগে ফিরতে হবে, সাবাথ পালন করা আবশ্যিক। নামগিয়াল বুদ্ধিমানের মতন আরেকটা ইহুদি দলের সাথে ওদের মিলিয়ে দিল। আমাদের যাত্রা সঙ্গী পাওয়া গেলো, ইসরায়েলি দম্পতি - রুমি (সেমিটিক উচ্চারণ হ্রুমি) ও মেইর (হ্মীর) । হিব্রু ভাষাটা শুনতে আরবি আর জর্মনের মাঝামাঝি। তাদের দৃষ্টিতে আপাতত নাইস গোত্র বা সাবাথ এর লক্ষণ নাই, সামনের চার দিনে কী ঘটে দেখা যাক। আমরা যাবার জন্য প্রস্তুত।আগামীকাল সকাল ৭টার সময় যাত্রা শুরু। সূচি নিম্নরূপ:

৬ তারিখ: লেহ থেকে তুর্তুক, খারদুংলা হয়ে।
৭ তারিখ: তুর্তুক থেকে  নুব্রা, ডিস্কিত-উন্ডার।
৮ তারিখ: উন্ডার থেকে প্যাঙগঙ, শয়ক উপত্যকা ধরে।
৯ তারিখ: প্যাঙগঙ থেকে লেহ, চ্যাঙ লা হয়ে।

বেশ দুধর্ষ পরিক্রমা। প্রথম দুদিনের রাত্রিযাপন লেহ থেকে কম উচ্চতায়, কিন্তু শেষের রাত প্রায় সাড়ে চার হাজার মিটার উচ্চতা।  এখন পর্যন্ত আমরা সুস্থই বোধ করছি। নামগিয়াল কে দিল্লির জন্য টিকেট দেখতে বললাম। ১০ তারিখের টিকেট এর দাম অনেক বেশি (রবিবার বলে হয়তো) হওয়ায় ঠিক হলো ১১ তারিখের টিকেট কাটবো।  উমাসিলার পাশের তিব্বতি টিশার্টের দোকানে আবার গেলাম, খারদুংলার দুটা টিশার্ট কেনা হলো, সকালে টিশার্ট পরেই খারদুংলাতে ছবি তুলতে হবে - ডাক্তারের প্রতিজ্ঞা। আমরা চ্যাঙসপা থেকে আবার মেইন বাজারের দিকে গেলাম।


আমরা বেশ সাবধানেই চলার চেষ্টা করছিলাম সারাদিন এএমএস এর কথা ভেবে। তবু অক্সিজেনের অভাব স্পষ্ট, বাতাস বেশ হালকা।লেহ তে একটা অক্সিজেন বার আছে জানতাম, প্রতি মিনিট বিশ টাকা করে। সেটার প্রয়োজন অবশ্য হলো না। হালকা মাথাব্যাথা আছে, তবে সেটা ক্ষণস্থায়ী। ডাক্তারও মোটামুটি সবল আছে।  শ্বাসকষ্টের জন্য ইনহেলার-সালবিউটামল নেয়া হলো প্যাঙগঙ কথা চিন্তা করে। অরেঞ্জ জ্যুস, পানির বোতল, আরো কিছু শুকনা খাবার কিনে লারদাকে ফিরে এলাম। গেট খুলতেই আবার লাকি। আমার পায়ের উপর ভর দিয়ে নাকে মুখে চাটার চেষ্টা - কি জ্বালা!

রাতের খাবার জুলে দিদির কাছে। সকালেই বলে দিয়েছিলেন। লাদাখী কিচেন দেখার সৌভাগ্য হলো প্রথম বারের মতন। খাবারের মেন্যু সাদা ভাত, রাজমাহ, বোকচোই, দই, সালাদ।  দুর্দান্ত রান্না, সত্যি বলতে, আমাদের এবারের ইন্ডিয়া ভ্রমণে শ্রেষ্ঠ ভোজ!  খেতে খেতে গল্প হলো কিছু। আমাদের ব্যাগ একটা কমিয়ে এখানেই রেখে যাবার সিদ্ধান্ত হলো। ফিরে এসে এখানেই উঠবো।এমন আতিথেয়তা লাদাখে আর পাবো কই? রাতে ব্যাগ গোছগাছ করে আগে আগে ঘুমাতে গেলাম, লাকিকে এড়িয়ে টয়লেট সেরে এসে শুয়ে পড়লাম জলদি জলদি। গুইলিও বলেছিলো, এই এলাকায় কুকুরের অনেক হাঁকডাক।  গতরাতে কিছু টের পাই নি, আজকে শুরু হলো, বৃষ্টির ধারার মতো লাকি ও তার ভাই বেরাদরেরা এক অদ্ভুত সুর তাল লয় হীন সংগীত চালু করে দিয়েছে। তার মধ্যেই ঘুম এসে গেলো, স্বপ্নের মধ্যেও দেখি - লাকি! কুকুর-ভীতি যা যাত্রা বোধ হয় কেটেই যাচ্ছে!
(চলবে)