Thursday, July 21, 2016

দুর্গমগিরি, কান্তার মরু

বাইশ

শ্রীনগর-লেহ হাইওয়ের ঠিক মাঝ বরাবর কার্গিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতাও মাঝারি - ২৬৭৬ মিটার। এখানে বিরতি দেয়া এক্লিমাটাইজেশনের জন্য সুবিধাজনক, দেহ ধীরে ধীরে লেহ বা তার আশেপাশের উচ্চ স্থানগুলির জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। দিল্লি থেকে যারা উড়ে লেহ যায়, তারা হুট্ করে উচ্চতার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত ঠিকঠাক আসতে পেরে আমরা আশাবাদী হয়ে উঠছি। কালকের দিনশেষে বহু কাঙ্ক্ষিত লেহ পাওয়া যাবে। হোটেলের পাশের রেস্টুরেন্টে খেতে বসলাম। আমি আগের দিনের থুকপা খেয়ে বিরক্ত, আজকে নিলাম চাপাতি আর ডাল ফ্রাই, ডাক্তার স্যুপ আর মুর্গ বিরিয়ানি, কার্গিলের অতি বিখ্যাত নন-ভেজ। পাশের টেবিলে ইতালিয়ান ছোকরা। মৃদুভাষী, নাম গুইলিও, শুধু এক টুকরা  চিজ স্যান্ডউইচ দিয়ে ডিনার সারলো । বাড়ি ইতালির উত্তরে, আল্পসের পাদদেশে, মিলান আর তুরিনের মাঝে। নিজে থেকেই আলাপ করতে এলো।  বাংলাদেশি শুনে সহানুভূতি প্রকাশ করলো, ঢাকার ঘটনার জন্য।   


গুইলিও শ্রীনগর থেকে এসেছে আমাদের সাথে। কার্গিলের পর জংস্কর ভ্যালির দিকে যাবে, গন্তব্য পাদুম। দুর্গম রাস্তা, বাস নেই, শেয়ার জিপে করে ১৪-১৫ ঘন্টার পথ কার্গিল থেকে। গুইলিও এর আগে লেহ ঘুরে এসেছে, নুব্রা, প্যাংগং ইত্যাদি। সবখানে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে।  গুইলিও আমাদের প্ল্যান জেনে  তুর্তুক যাবার জন্য বললো।  কিন্তু তাতে এক দিন সময় বেশি লাগবে। গুইলিও প্রত্যেকটা জায়গায় কিভাবে যেতে হবে, কোথায় থাকতে হবে, খরচ কেমন হবে, খুব সুন্দর একটা ম্যাপ করে দিল। ওর কথা বার্তায় মনে হলো আমাদেরকে পছন্দ করেছে বেশ। ভারতে গুইলিওর এটাই প্রথম আসা না, এর আগে লাহুল-স্পিতি, কিন্নর দেশ ঘুরে দেখেছে। নেপালেও গিয়েছে, জমশম-মুসতাঙ নিয়ে গুইলিওর আগ্রহ ও জ্ঞান আমাকে মুগ্ধ করলো। আমার আর ডাক্তারের জীবনের কয়েকটা আরাধ্য গন্তব্যের একটা: মুসতাঙ।


গুইলিও সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার ছিল, কিছু দিন কাজ করার পর টের পেল কাজের সময়ের বাইরেও কাজের চিন্তা তার স্বাভাবিক জীবনের থেকে সময় কেড়ে নিচ্ছে। ঠিক দুবছর কাজ করার পর চাকরি ছেড়ে দেয়, নিজের ইচ্ছামতন জীবন যাপনের জন্য। সেই থেকে শুরু। ইন্ডিয়া ও এশিয়া তার প্রিয়। গুইলিওর কাছ থেকে ওর ইমেইল ঠিকানা নিয়ে নিলাম, পরে গুগল করে দেখলাম গুইলিও একটা আলপাইন ট্যুরিজম কোম্পানি দিয়েছে তার শহরে।  শান্তিদার স্ত্রীর বিদূষী-কথকপনায় সেও যারপরনাই মুগ্ধ! আমি বোঝালাম, আমরা বাঙালিরা এমনই, উল্লসিত হলে গলার জোর বেড়ে যায়। গুইলিও কে ভালো লাগলো, তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার জন্যও। ডাক্তারকে দেখে জাপানি-কোরিয়ান না বলে বার্মিজ/অসমীয়া মনে হয়েছিল তার কাছে। ডাক্তার মুগ্ধ।


গুইলিও কে বিদায় দিয়ে আমরা রুমে ফিরে আসলাম। পরদিন খুব ভোরে উঠতে হবে, রফিক ভাই এর কথা মনে আছে।  আজকেও ঘুমে ব্যাঘাত হলো না, বোধকরি লম্বা ভ্রমণ জনিত ক্লান্তির কারণে। এই উচ্চতায় ঘুম যত ভালো হয় ততই ভালো।  খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলো।গুইলিওর আধঘন্টা আগেই বেরোবার কথা। হোটেল চেকআউট করে হোসেনী পার্কে আমাদের বাসের কাছে পৌঁছে দেখি, বাস আছে, রফিক ভাই রেডি, চেকদ্বয়, অন্ধ্র প্রদেশের দুজন, কাশ্মীরি পরিবার, নতুন ক'জন যাত্রী, সব আছে, বৃহৎ বাঙালি পরিবার অনুপস্থিত। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, রফিক ভাই বেশ বিরক্ত। আমাদের সাথে আলাপ করতে শুরু করলেন। ডাক্তার আলাপ জুড়ে দিলো কাশ্মীরি পরিবারটার সাথে। মেয়েটা স্কুলে পড়ে, চতুর্থ শ্রেণীতে, নাম মেধা, ডাক্তার হতে চায়, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারও হতে চায়।  স্কুলে অনেকগুলি সাবজেক্ট: কম্পিউটারও আছে। ভাষা শিখছে চারটা: হিন্দি, উর্দু, কাশ্মীরি, ইংরেজি! বছরে পাঁচটা এক্সাম। লেহর কাছে এক আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে।

এর মধ্যে এক জন একজন করে ধীর লয়ে আসতে শুরু করেছেন বৃহৎ পরিবারের লোকজন। আমরা ব্যাগগুলি ছাদে রাখতে রাখতে শান্তিদার স্ত্রী হাজির। আবার গোল! আজকে নতুন এক যাত্রী এসে সামনের সিটে বসে গেছে। গতকালের দুই কোরীয় পিছনের দিকে। শান্তি দি (এ নামেই ডাকা যাক) গত দুপুরের মতন সামনে বসতে গিয়ে দেখে জায়গা দখল। রফিক ভাই বিরক্ত। কোনোমতে একজনকে সরিয়ে শান্তিদিকে বসতে দেয়া হলো। বসেই পাশের লোক কে "হামি বমি করবো" ইত্যাদি ইত্যাদি বলে ডরানোর চেষ্টা। পাশের ভদ্রলোকের কোনো পরোয়া নেই।  এর মধ্যে শান্তি দি আবার চেঁচাতে লাগলেন সকালের চা ইত্যাদির পর বাসন কোসন কে পরিষ্কার করবে এইসবের হাবিজাবি নিয়ে, উপরন্তু তাদের কোলকাতা প্যাকেজের সাথে কার্গিলের রাতে থাকার জনপ্রতি ১৮৩ টাকা অতিরিক্ত যোগ হলো কেন ? ঠিক কার কাছে অভিযোগ করছেন বোঝা গেলো না। মহারাজ চলে এসেছিলেন, রফিক ভাই এর মেজাজ দেখে আবার বাকীদের ডাকতে গেলেন। ধীরে ধীরে সবাই এলেন, সর্বসাকুল্যে মাত্র আধ ঘন্টা দেরি হলো।  এবার লাল্টু বসেছে তার বাপের সাথে, শান্তি দা পেছনে, আর আমাদের ঠিক পিছনে গুইলিওর জায়গায় তন্ময় ওরফে তনু।  ভোরের আলোতেই কার্গিল থেকে রওনা দেয়া গেলো। আজকের সকালে কার্গিল আরো সুন্দর দেখাচ্ছে।

এখন থেকে লেহ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ।  সবুজের মাত্রা আরো কমবে। প্রথম দুঘন্টায় এক দুইটা ভ্যালিতে সবুজ পাওয়া গেলো, বাকি সব একেবারেই ধূসর পাহাড়।  কদাচিৎ তুষার শুভ্র শৃঙ্গ।  এছাড়া পাহাড়ের গায়ে সবুজের নামগন্ধ নেই।  প্রকৃত লাদাখ।  বা দিকের পাহাড় গুলির উপরের দিকে তাকালে ১৯৯৯ এর কার্গিল যুদ্ধের কথা মনে  পড়ে, এই আশপাশের কোনো এক খাজ এর উপর দিয়েই পাকিস্তানির অনুপ্রবেশকারীরা ন্যাশনাল হাইওয় ১এর দখল নিয়েছিল, উদ্দেশ্য লেহর সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, সিয়াচেন হিমবাহে বচসার একটা পরিবেশ তৈয়ার।  একেকটা পাহাড়ের গায়ে এখনো কামান বা মর্টার বসানো দেখা গেলো।দূরের শত্রুকে সাবধান করে দেয়া। ভাবতেই অবাক লাগে, এই উঁচুতে জল নেই, হাওয়া নেই (বাতাসে অক্সিজেন কম), এর মধ্যেও মানুষ যুদ্ধ করে, ভূমির জন্য প্রাণ দেয়!

মূলবেখের আগে একটা গ্রামে থামলো। এ পর্যন্ত রাস্তা মোটামুটি সবুজ ছিল নিচের ভ্যালিতে, সরিষা বা ধানক্ষেতও, এর পরে তা আরো দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে। সুরু ভ্যালির শেষ, এর পর আবার সিন্ধুর দেখা না পাওয়া পর্যন্ত সবুজ আর নেই, হ্যা একেবারেই নেই। এখানে সকালের নাস্তা। সিদ্ধ ডিম, চাপাতি আর চা। হলুদ রঙের ডিম দেখে দুই জর্জ সন্দেহ প্রকাশ করায়, ডাক্তার হলুদ রঙের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে লেগে গেলো। ডাক্তারের কপালে একটা ডিমভাজিও জুটে গেলো, আগের দিন থেকে সে অমলেটের স্বপ্ন দেখছে। এখানে আমাদের প্রথম খোলা আকাশের নিচে প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারতে হলো।  একেবারে কোনো ব্যবস্থাই নেই এ ছাড়া। গুল পানাগের ডকুমেন্টারিতে দেখেছিলাম গুল আর তার বন্ধু কত খুশি ছিল লাদাখের খোলা প্রান্তরে হাগামুতা করার পর, আমরাও খুশি। এই গ্রামটাও মুসলিম প্রধান। তবে তিব্বতি স্টাইলের ঘরবাড়ি শুরু হয়ে গেছে। পাহাড়ের চূড়া বা রাস্তার ধারে বৌদ্ধ প্রেয়ার ফ্ল্যাগ এর আনাগোনা। এই রাস্তায়ও মোটর বাইক আরোহী কম।


তেইশ
আগের দিনের দ্রাস-কার্গিল রাস্তার মতন কার্গিল-লেহ গোটা রাস্তাও খুবই চমৎকার ভাবে তৈরি করা এক দুই জায়গা বাদ দিলে। মূলবেখের পর এতো বড় সবুজ গ্রাম আর নেই। অনেক দূর পর্যন্ত রাস্তায় না কোনো নদী, না কোনো উপত্যকা। একটা কুকুর চোখে পড়ল, দেখতে ঠিক নেকড়ের মতন, ডাক্তার পার্বত্য নেকড়ে দেখে ফেলেছে বলে খুশি হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু আসলে কুকুর। লাদাখি কুকুরের অনেক গল্প শুনেছি, এদের গায়ের লোম লম্বা বেশ, নেকড়ের মতন, এজন্য নেকড়ে বলে ভ্রম হয়। নামিক লা পার হয়ে ওপারের পাহাড়ে যেতে রুক্ষ ভূমিতে এক পাল ভেড়া চোখে পড়ল।  এই মরুতে শুষ্ক-হলুদ প্রায় কয়েক গোছা ঘাস ছাড়া কিছু চোখে পড়ছে না।  অথচ বালতালের আগে কত গরু-ছাগল, এমনকি দ্রাসের রাস্তায় বা পাশের উপত্যকায় অনেক ঘোড়া চড়তে দেখেছি। এগুলি নেহায়েতই পোষ মানানো পার্বত্য ভেড়া বা ছাগল। পাহাড় গুলি কোনো কোনোখানে গ্রান্ড ক্যানিয়নের মতন, কোথাও আবার মনুমেন্ট ভ্যালির মতন রং ও বৈচিত্র্যে। একজায়গায় মনে হলো একটা বাঁদর, আরেক জায়গায় ঠিক মেক্সিকান হ্যাট এর মতন, মনুমেন্ট ভ্যালিতে কলোরাডো ছিল, এখানে আপাতত কোনো নদী নেই।  এক জায়গায় শান্তি দিদি চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, লাল্টুকে, "দেখ কেমন পাহাড়টা কেমন ডাইনোসরের কুঁচকির মতন দেখতে!" অব্যর্থ উপমা।


পিছনে একটা বিশাল আর্মি কনভয় ছিল।  এত সুন্দর রাস্তার জন্য উদ্দেশ্য শুধু যে লাদাখী লোকসেবা তা নয়,ভারতীয় আর্মির নিজস্ব স্বার্থ আছে। তবু এই রাস্তাটাই লেহ -শ্রীনগর লাইফলাইন।  ছয়-সাত মাস খোলা থাকে বছরে, অন্যদিকের মানালি-লেহ রোড খোলা থাকে মাত্র সাড়ে তিন মাসের মতন। একটা ভাঙা ব্রিজের কাছে থামতে হলো, ওপাশ থেকে আধ ঘন্টা ধরে শুধু আর্মির বড় বড় ট্রাক এলো।  ডাক্তার গুনতে আরম্ভ করছিল কাজ না পেয়ে। কয়েকটা মোটর বাইক, তার সামনেও প্রেয়ার ফ্ল্যাগ বাঁধা। এরই মধ্যে রাস্তার মেরামত কাজ চলছে, মেরামতকারীদের তাবু পাওয়া গেলো রাস্তার পাশেই। মূলবেখের পর থেকে রাস্তা উঁচু দুটো গিরিপথ পার হয়, কোনোটাই জোজিলার মতন ভয়ংকর নয়, যদিও জোজিলা থেকে উচ্চতায় বেশি: নামিক লা (৩৭০০ মিটার) এবং ফতুলা (৪১০৮ মিটার) ফটুলা থেকে লামায়ুরুর দারুন ভিউ পাওয়া যায়, এখানেই লামাউরুর বিখ্যাত বৌদ্ধ গুম্ফা (gompa)। ছোট একটা বিরতি হলো। এখন বাস থামলেই সবাই রাস্তার ধরে বেশ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। লামায়ুরুর খানিক পরে আমাদের চোখের সামনে একটা একসিডেন্ট হতে হতে বেঁচে গেলো, ছোট দুটা গাড়ির সংঘর্ষ, ড্রাইভারের দোষ। কার্গিল থেকে লামায়ুরু মাঝামাঝি।মূলবেখ থেকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছিলো বাটালিকের দিকে, একেবারে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে। সেই রাস্তা আবার বাটালিক ঘুরে শ্রীনগর-লেহ হাইওয়েতে মিলেছে খালৎসির কাছে এসে। এখন থেকে লেহ আর ৯৭ কিলোমিটার। একটা মিলিটারি চেক পোস্ট আছে, বিদেশীদের নিবন্ধন ইত্যাদি। এখানে আমরা টুকটাক ফটোগ্রাফি করলাম। বাঙালি পরিবার  লাল্টুর মন খারাপ। তার একটা একক ছবি হলো না। শান্তিদি বোঝাতে লাগলেন, "ভাবিস নে, তনু কম্পিউটার করে তোর  মুন্ডু বসিয়ে দেবে, দাদা ওসবই তো শিখছে!" গর্বিত মা জননী।

খালৎসির কিছু আগ থেকে সিন্ধুর দেখা পাওয়া গেলো।এখানে অবশ্য কঙ্গনের সেই খরমূর্তি অার নেই। বোঝা গেলো  সিন্ধুর দুপাশ বাদ দিলে এই মরুর মধ্যে আর কোথাও সবুজের ছিটেফোঁটা পাওয়া যাবে না।  রাস্তা খুবই চমৎকার। সাসপোল - একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামের মতন -লাদাখি।  বেশ একটা বিরতি নিল ড্রাইভার। এখানে আমরা একটু ঘোরাঘুরি করলাম গ্রামের ভিতর, একটা ছোট গুম্ফা আছে, লাদাখি ঘরবাড়ি, পিয়ারের বাগান, সেখান থেকে ছিড়ে খেতে শুরু করেছে গোটা বৃহৎ পরিবার। আমরা ব্লগ থেকে শেখা প্রথম লাদাখী শব্দটির প্রয়োগ ঘটালাম, "জুলে!" এক বৃদ্ধ ডাক্তারের জুলের প্রত্যুত্তরে নির্মল হাসি সহ যেভাবে "জুলে" বলল, ভোলার মতো নয়। জুলের অর্থ স্বাগতম + ধন্যবাদ + হ্যালো + হাই সব কিছু।  একটা লাদাখি তরুণী বারান্দার উপর থেকে এক গামলা তরল নিচে ছুড়ে মারলো, আমরা নিচে হাটছিলাম, অল্পের জন্য গায়ে লাগলো না, আমি হেসে বললাম, "জুলে", সেও লজ্জিত মুখে দু;খিত হবার মতন করে, "জুলে। " একটা সার্বজনীন হৃদ্যতাসূচক  উচ্চারণ।

লামায়ুরু থেকে বেশ কয়েকজন ককেশাস তরুণ-তরুণী উঠেছিল বাসে। ইংরেজি বলার ধরণে আমেরিকান মনে হলো। আমরা বাসে বসে প্রচুর পরিমাণে জল আর বাদাম-চকোলেট এগুলি চিবিয়ে যাচ্ছিলাম।  আকাশটা ঝকঝকে - অল্প সাদা মেঘ - তার সাথে গেরুয়া বা ধূসর পাহাড় - আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে। একটা ভ্যালি মতন পাওয়া গেলো। এজায়গাটা দেখতে হুবুহু আরিজোনার মতন, পেজের এন্টিলোপ ক্যানিয়নে যাবার রাস্তা যেমন ছিল। চারিদিকে মরুভূমি, দূরে বড় বড়  ইলেকট্রিক পোস্ট। পাহাড় আর তার উচ্চতায় আরিজোনা ফেইল।

ডানে আলচির রাস্তা আর বায়ে লিকির। জায়গাটার নাম ফে। কাশ্মীরি পরিবারটা এখানে নেমে গেলো। লেহ আর এক ঘন্টার পথ। ড্রাইভার রফিক ভাই এর ইশারায় সামনে গিয়ে বসলাম, ডাক্তার যাবে না। বাসে ড্রাইভারের পাশে একটা পাটাতন মতন। এখানে বসেই কাশ্মীরি পরিবারটা যাচ্ছিলো। খুব আরামের জায়গা, সামনে বায়ে ডানে ভিউ মিলছে দারুন - ডিলাক্স! একটা আমেরিকান তরুণীও আমার গা ঘেঁষে বসে গেলো। লেহ আর বড়জোর দেড় ঘন্টা।

ফে'র পরে এলো একটা গুরুদুয়ারা- নাম পাত্থর সাহিব। ভালোই ভিড় দেখা গেলো তাতে। মনে পড়লো হেমকুন্ডের কথা, ওখানে এখন বন্যা শুরু হয়েছে। ভাগ্যিস এই পথ নিয়েছিলাম। খানিক পরে এলো বহু প্রতীক্ষিত ম্যাগনেটিক হিল। এ পর্যায়ে ড্রাইভার রফিক ভাই, স্টার্ট বন্ধ করে দিলেন গাড়ির।আমি ডাক্তার কে ডাকাডাকি করে ব্যর্থ হলাম, বেঘোর ঘুমে। স্টার্ট বন্ধ করা গাড়ি একটা ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠছে। অপটিক্যাল ইল্যুশন।  আসলে ঢালটা নিচের দিকে। ঠিক আগের মাসেই মদিনার কাছে এমন একটা জায়গার কথা শুনেছিলাম, ওটিকে অবশ্য ভক্তকুল জ্বিনের কারবার ভাবে। ম্যাগনেটিক হিলের  কাছের ভ্যালিটা দেখতে দারুন। রফিক ভাই ফে'র পর থেকে প্রায় ট্যুরিস্ট গাইডের মতন এটা কি, ওটা কি দেখিয়ে চলেছেন। কিছুদূর এগিয়ে দূরে নিচের দিকে লেহর প্রথম দর্শন মিললো। সেই সাথে লাদাখ রেঞ্জ - স্তোক কাংড়ি!  রাস্তা এখন প্রায় সমতল, সিন্ধু বাহিত লাদাখ উপত্যকতা - একটা সাইন বোর্ড দেখলাম ইউনিভার্সিটি অফ কাশ্মীর, লেহ ক্যাম্পাস। শ্রীনগরে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পৃথিবীর সুন্দরতম ক্যাম্পাসগুলির একটা, এখানে মরুভূমির মধ্যে কয়েকটা কদাকার বিল্ডিং চোখে পড়লো। লেহ এয়ারপোর্ট এর পাশ দিয়ে রাস্তা এখন অল্প উঠতে শুরু করেছে আবার, লেহ শহর - উচ্চতা ৩৫০০ মিটার !


চব্বিশ
লেহ শহরে ঢুকতে হয় একটা তোরণের ভিতর দিয়ে, প্রেয়ার হুইল একটা বিশাল।বৌদ্ধ অধ্যুষিত স্থান। বাস স্ট্যান্ড টা ঢালের মধ্যে, বেশ ভিড়। কিন্তু শ্রীনগরের মতন টানাটানি নেই।  রফিক ভাইকে বিদায় বলে একটা ট্যাক্সি নিলাম। ডাক্তার উঠেই একটা ঝাকি খেলো। ড্রাইভার লাদাখি। লেহর ট্যুরিস্ট এলাকা এখান থেকে শুরু। এখান থেকে, পাহাড়ের উপর দিকে উঠতে হয়. প্রথমে মেইন বাজার (এই নামেই ডাকে), সেখান থেকে জামিয়া মসজিদ (এই জায়গাটা পথচারীদের জন্য, ট্যাক্সি বা অন্য গাড়ি প্রবেশ নিষেধ, অনেকটা দার্জিলিং এর ম্যাল এর মতন), এক পাশে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, এর পর আরেকটু উপর থেকে শুরু হয়েছে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা এ জায়গাটার নাম, চ্যাঙসপা। চ্যাঙসপা  ১-২ কিলোমিটারের মতন লম্বায়, ঢাল বেয়ে উপরের দিকে, খুব কঠিন ঢাল না।  দুপাশে প্রচুর রেস্টুরেন্ট, হোটেল, গেস্টহাউজ, ট্যুরিস্ট এজেন্ট আর ইউরোপীয়। অনেকটা পোখারার মতন। ভারতীয় ট্যুরিস্ট কম। আমাদের ট্যাক্সি চ্যাঙসপা সেন্টারে একটা ছোট্ট নদীর নদীর উপর ব্রিজ আছে, পাশে একটা বড় প্রেয়ার হুইল, হোটেল ওমাসিলা, তার কাছে নামিয়ে দিল।


হোটেল ঠিক করা নেই, ইচ্ছে গুইলিওর দেয়া ঠিকানা থেকে লারদাক গেস্ট হাউজ খুঁজে বের করা। লোনলি প্ল্যানেট কাজে দিলো। ম্যাপ থেকে বুঝলাম আমরা আশেপাশেই কোথাও আছি। মেইন রোড থেকে গ্রামের রাস্তা নিলাম। লাদাখী গ্রাম, পাথর বিছানো পথ। কয়েকটা পাহাড়ি গাই মাঝে পথ রোধ করে আছে, এখানে সেখানে তাদের বিষ্ঠা। একটু ঘুরপথে গিয়ে পেলাম। গেটে লোক নেই। ভিতরেও কেউ নেই।  গুইলিও বলেছিলো অনেক কুকুর এলাকায়, এখনো কাউকে দেখিনি। সামনের সবজি ক্ষেতে কয়েকজন কাজ করছে, একটু ডাকাডাকি করতেই হলো। একটা ককেশাস মেয়ে উপর থেকে সাড়া দিল, ট্যুরিস্ট, বোর্ডার হবে। সে জুলে বলে ডাক দিল, খেত থেকে অন্য একটা মেয়ে হাত ইশারা করে আমাদের কিছু একটা বললো। বোর্ডার মেয়েটা ইংরেজিতে বললো, রুম খালি আছে, তোমরা দেখতে পারো, আমরা ওর ইশারায় ৩ টা রুম দেখলাম, লাদাখী কায়দার বাড়ি। উপরের একটা পছন্দ হলো, কিন্তু ওটা তালাবন্ধ। দোতলার বারান্দায় ব্যাগ রাখতে সবজি ক্ষেতের মেয়েটা আসলো। বোর্ডার তাকে "জুলে" বলে ডাকছিলো, সেই থেকে আমার মনে হতে লাগলো, মেয়েটার নামই বুঝি, "জুলে"।

এর পরের ক'দিনে আমি আর ডাক্তার নিজেদের মধ্যে একে "জুলে দিদি" আর তাকে দিদি বলে ডাকতে ডাকতে, এতটা অভ্যস্ত হয়েগেছিলাম যে তার নামই জানা হয় নাই, কী ভীষণ লজ্জার কথা! আমাদের কাছে জুলে দিদিই লাদাখ, আমাদের লাদাখী আপনজন। জুলেদিদি অবশ্য এ মুহূর্তে ভীষণ ব্যস্ত। আমাদের আপাতত দোতলার রুমেই ব্যাগ ইত্যাদি রাখতে বললেন। উপরের যে রুমটা পছন্দ ছিল, সেটাই অন্য একজনের উঠার কথা, না উঠলে আমাদের দেবেন কথা দিয়ে কাজে চলে গেলেন। ভাঙা ভাঙা হিন্দি তার, আমাদেরও, ভালোই মিল হলো। রুমটা ভালোই, একটা  বিছানা,ছোট ২টা টুল টেবিল আছে। এটাচড টয়লেট নাই। এই মুহূর্তে বিদ্যুৎ নাই, দুপুরবেলা। দুজনেই টায়ার্ড।অনেক সময় পাওয়া গেলো, শ্বাস নিতে একটু একটু সমস্যা টের পাওয়া যাচ্ছে। পরের দিনটা ফ্রি আছে, ঘুম দিব কিনা ভাবছিলাম। দরজা বন্ধ করতে গেলাম, ডাক্তার আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো খোলা রাখতে।

ঘুম দিলাম। ঘুমের ভিতর ডাক্তার দু;স্বপ্ন দেখছিলো, ফ্রয়েডিয়ান। আমার মুখের কাছে হঠাৎ কারো জোর শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার শব্দ মনে হলো, ভাবলাম ডাক্তার হয় তো, চোখ মেলে দেখি, ডাক্তার না, একটা কুকুর ঠিক আমার মুখের কাছে জিভ মেলে "হেহ হেহ হেহ" করছে। আতংকে তড়াক করে উঠে গেলাম, ডাক্তারও হুড়মুড়িয়ে, তার স্বপ্নের অবস্থা কাহিল। কুকুরটাকে কোনো রকমে তাড়ানো গেল।  এবারে দরজা বন্ধ। সারা বিছানায় কুকুরটার গায়ের রোমে ভরে গেছে, কোনোমতে ঝেড়ে টেরে আবার শোয়ার চেষ্টা করা গেলো, ঘুম হলো না।  বাইরে এসে জানলাম কুকুরটার নাম, 'লাকি', আমাদের উপরের রুম ততক্ষনে পাওয়া গেছে, ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড পাওয়া গেলো, লারদাক গেস্ট হাউজের মালিক লাদাখী ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলো অল্প। আমরা ব্যাগ সহ নতুন রুমে উঠলাম। লাকি প্রায় আমার গায়ের উপরে উঠে গেছিলো। ভয়ে আছি, দ্রুত ফ্রেস হয়ে লারদাক থেকে বের হয়ে এলাম।


  
বের হয়ে ওমাসিলার কাছে যেতেই একটা টুরিস্ট এজেন্সি চোখে পড়লো, "গ্লোবাল এক্সপ্লোরার" - স্বত্বাধিকারীর নামগিয়াল।
গুইলিও বলেছিলো, উজ্জ্বল কাগজে শেয়ারড জিপ এর বিজ্ঞাপন খুঁজতে।এখানেও পেলাম।চারদিন-তিনরাত / লেহ -তুর্তুক-নুব্রা-প্যাঙগঙ-লেহ। আমাদের টার্গেট ৩ দিন ২ রাত। আরো কয়েকটা সাইন, ভাষা দুর্বোধ্য - হিব্রু। ভিতরে দেয়ালে দালাই লামার একটা ছবি ঝোলানো। নামগিয়াল খিল খিল করে হাসে। আমরা বাংলাদেশ শুনেও খিল খিল করে হেসে বললো, বাংলাদেশ তো পারমিট পায় না। আমরা খুব অবাক হলাম। বললাম, আমাদের বন্ধু তো পেয়েছে। সে কোথায় ফোন করলো, কি কি বললো লাদাখীতে এর পর ফোন রেখে আবার খিল খিল। বাংলাদেশি তে সমস্যা নাই, আমরা তার প্রথম বাংলাদেশি কাস্টমার। পারমিটের জন্য কতদিন লাগবে, সে বললো, আজকে দিলে কালকে পাবা। আমরা পাসপোর্ট দিয়ে দিলাম। পারমিটের খরচ ৬০০ টাকা করে। ট্যুর এর ব্যাপরে জিজ্ঞেস করায় সে বললো ট্যুর আছে চারদিন-তিনরাত, খরচ তিনহাজার জনপ্রতি, এক জিপে ছয়-সাত জন করে।আমরা এবারে ভেবে বলবো বলে নিয়ে বের হয়ে এলাম। সে খিল খিল করতে করতে আমাদের বিদায় দিল।   


পাশেই একটা ছোট্ট পাহাড়ি নদীর কথা বলেছিলাম, ওটার ধারেই একটা রেস্টুরেন্ট - জেন গার্ডেন। আজকে লাঞ্চ হয় নি, বেশ সময় নিয়ে আর্লি ডিনার করবো বলে বসে গেলাম। উদ্দেশ্য প্ল্যান স্থির করা আর জিরানো। ওয়াইফাই পাওয়া গেলো। খাবার ভালো ছিল, একটা নেপালি ছেলে অর্ডার নিচ্ছিলো, লেবু-মধু দিয়ে আদা চা, লোনলি প্ল্যানেট বলেছিলো বেশি বেশি করে খেতে। গরম পানি ভরে নিলাম। মাশরুম ফ্রাইড রাইস, মমো আর চাপাতি - ডাল। আমি বেশ ডাল-রুটি খেতে শুরু করেছি, থুকপার শোকে। বিদ্যুৎ চলে গেলো। একটা হারিকেন দিয়ে গেলো নেপালি ছেলেটা। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ১২ তারিখ যেহেতু ফেরার ফ্লাইট, আজকে ৪, কালকের দিন বিশ্রাম, ৬-৭-৮-৯  চার দিনের ট্যুর শেষে আরামে ১০-১১ তে দিল্লি হয়ে কলকাতা ফেরা যাবে, মিনুকে বুঝিয়ে বললেই হবে। তুর্তুক যেতেই হবে। গুইলিওর কাছ থেকে শোনা অবধি মানস চক্ষে ভাসছে তুর্তুকের ছবি।

বের হয়েই আবার গেলাম নামগিয়ালের কাছে। সে তখনও খিল খিল করছে।আমরা বললাম যেতে চাই, সে খিল খিল - "জায়গা নাই। " মানে তখন যে জিপটার বিজ্ঞাপন ছিল, সেটা আর নাই, বুকড অলরেডি। তবে চিন্তার কিছু নাই, আগামীকাল সারাদিনের মধ্যে কিছু একটা ম্যানেজ হবে - খিল খিল। আমরা দিল্লির জন্য ১০ তারিখের টিকেট দেখতে বললাম।  সেটাও নাকি কাল হয়ে যাবে - খিল খিল।  আমরা পরের দিন দেখা করবো বলে বিদায় নিলাম। নামগিয়ালের অফিসের দেয়াল জুড়ে হিব্রুতে নানান নোটিশ ইত্যাদি।দালাই লামার ছবির পাশে উপরে একটা হিব্রু প্রশংসাপত্র মনে হলো। আমরা যখন বসে ছিলাম তখনও আরো যারা কাস্টমার ছিল তারা সবাই হিব্রুভাষী - ইসরায়েলি। কোনো এক ট্যুরিস্ট প্রশংসাপত্র লিখে গেছে তার স্বদেশী বা স্বভাষীদের জন্য।

ওমাসিলার পাশেই একটা টিশার্ট ইত্যাদির দোকান। দোকানি তিব্বতি।নিজেই কাপড় ডিজাইন করে, আমাদের সামনেই সেলাই করছিলো। একটা লাল টুপি পছন্দ হলো, শীতের মধ্যে কাজে দিবে। দুইটা কিনে নিলাম, আরেকটা বন্ধু দিপুর জন্য গিফট। ছেলেটা বলল, তোমাদের অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে, আজকে আর কোথাও যেও না, চ্যাঙসপা দিয়ে নিচের দিকে ভুলেও না, আবার ফিরতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বে। রেস্ট নাও। কয়েকটা জলের বোতল কিনে লারদাকে ফিরে এলাম। গেট দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে লাকির আক্রমণ। দৌড়ে এসে আমার উরুতে ভর রেখে আবার মুখের কাছে আসার ইচ্ছা, কোনোমতে সরালাম, "লাকি লাকি" ডাক দিয়ে পরিচিতের ভাব নিলাম, কোনো কাজ হচ্ছে না।  জুলেদিদি এসে এ যাত্রা বাঁচালেন। ততক্ষনে লাকির আঁচড়ে উরুতে একটু ছুলে গেছে, জুলে দিদি বললেন, ভয় নেই, ইনজেকশন দেয়া আছে, যত খুশি আঁচড়াক-কামড়াক! ডাক্তারও দেখলাম নিশ্চিন্ত! কালকে সারাদিন কোনো তাড়াহুড়া নেই। জুলেদিদি একটুপর চা বানিয়ে দিলেন, আমরা সকালে নাস্তার জন্য বললাম। এখন ঘুম দিতে হবে। কাল ভোরে ওঠার কোন তাড়া নেই।
(চলবে)