Wednesday, July 20, 2016

লাদাখ যাত্রার প্রাক্কালে

ষোলো

ঐ দিন রাতে খাবার সময় ওয়াইফাই পাওয়া গেলো।ঢাকার খোঁজখবর নেয়া গেলো। গোটা জাতি যেন স্তম্ভিত গুলশানের ঘটনায়। যদিও এর আগের ২-৩ বছর ধরেই প্রথমে মুক্তমনা ব্লগার, নাস্তিক, পুরোহিত, বিদেশি, দেশি, সুফি, পাদ্রী, ইমাম, মুয়াজ্জিন, ইত্যাদি নানান হত্যাকান্ড ঘটেই যাচ্ছিল। রাজনৈতিক ভাবে আমাদের দেশে এমন আবহ একদিনে তৈরি হয়নি।যদিও এর ব্যাপক বিশ্লেষণ এই ভ্রমণ কাহিনীর আলোচ্য নয়, কিন্তু আমাদের এই দফা ভ্রমণে আমরা রাজীনীতির আওতার বাইরে যেতে পারি নি, ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ইত্যাদি নানা কারণে।পর্যটন তো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, রাজনীতির বাইরে যাবারও উপায় নেই, মাধবকুন্ডের ইকোপার্কে গেলে শুধু ঝর্ণার শব্দ না, খাসিয়াপল্লীর কান্নার আওয়াজ আসতে বাধ্য। সেই একই কান্না মায়ানমারের সান উপত্যকায়, নাভাহোদের মনুমেন্ট ভ্যালিতে, এই কাশ্মীরে, লাদাখে।

কাশ্মীরে মুসলিম আগমন ১৩০০ সালের দিকে। লাদাখি রিনচেন কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক এবং এই এলাকায় মুসলিম আধিপত্যের ও জনসংখ্যা বিস্তারেও তার ব্যাপক ভূমিকা। মাঝে জয়নুল আবেদীন নামের এক উদার মুসলিম শাসকের আমলে অনেকে ধর্মান্তরিত হয় ইসলামকে ভালোবেসে, তরবারির ভয়ে নয়। ব্রিটিশ আমলে কাশ্মীরের শাসনভার ন্যাস্ত ছিল শিখ রাজাদের হাতে। নামমাত্র নজরানার (বছরে ছয়টা শাল, বারোটা ছাগল আরেকটা ঘোড়া) বিনিময়ে তারা কাশ্মীর শাসন করত। এদের বেশিরভাগ ছিল প্রচন্ড অত্যাচারী, প্রজাদের অবস্থা ছিল দাসানুরূপ। দেশভাগের সময়, কাশ্মীরের পঁচাত্তর ভাগ জনসংখ্যা ছিল মুসলিম।  ততকালীন রাজা হরি সিং ছিলেন কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে (যদিও গোপনে ভারতের সাথে আঁতাতের অভিযোগ আছে), কাশ্মীরের নেতা, পন্ডিত নেহেরুর বন্ধু, শের-ই-কাশ্মীর শেখ আবদুল্লাহ ইউনিয়নে থাকার দিকেই ছিলেন শুরুতে (কট্টর হিন্দুবাদী শ্যামাপ্রসাদ ইত্যাদির কল্যানে শেখ আব্দুল্লাহর মত পরবর্তীতে পাল্টে যায়)।  কিন্তু ততদিনে জম্মু-পাঞ্জাবসহ পাকিস্তান ও ভারতের নানা স্থানে শুরু হয়ে গেছে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। ঝিলম,মিরপুর বা মোজাফফরাবাদের অধিবাসীরা অনেক কাল ধরেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিয়োজিত ছিল, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী রদ হবার পর তাদের পুনর্বাসন ও অস্ত্র পুনর্বণ্টনে মুসলিমদের আপত্তি ছিল। সেইসব অস্ত্রই দাঙ্গার সময় হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায় মুসলিম নিধনে ব্যবহার করে। রাজার সিদ্ধান্ত নিতে দেরীর সুযোগে সীমান্ত প্রদেশের পশতুন জাতিকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান কাশ্মীর দখল এবং রাজাকে হঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে এবং প্রথম ইন্দো-পাক সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। সেই প্রেক্ষিতে রাজা ভারতের সাহায্য চাইলে, ভারতের শর্ত ছিল, কাশ্মীর কে অবশ্যই ভারত ইউনিয়নে যোগ দিতে হবে।

প্রতি আক্রমণে ভারত গুলমার্গ, বারামুল্লা ইত্যাদি পুনর্দখল করে কিন্তু পশ্চিমাংশের মুজাফফরাবাদ, মিরপুর এসব এলাকা অধিকৃত থেকে যায় এবং উত্তর দিকে গিলগিট ও বাল্টিস্তানের বেশিরভাগ জায়গা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।  এর পরে আরো অনেকবার ইন্দো-পাক সংঘর্ষে নিয়ন্ত্রণ রেখা কখনো ডানে-বায়ে কখনো উত্তরে-দক্ষিণে সরে গেছে।  খেয়াল করতে হবে কাশ্মীরের সাধারণ জনগণ অনেকটাই সুফি ভাবাপন্ন ও উদার ছিল, তাদের বেশিরভাগই ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। ফলে এই নিয়ন্ত্রণ রেখার বাইরে আজাদ(স্বাধীন) জম্মু-কাশ্মীরের চেতনায় তাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠা অস্বাভাবিক কিছু না।  কিন্তু দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তান যেসব জিহাদি আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে এসেছে, সেগুলি কাশ্মীরের স্বাধীনতা কামনার সাথে সাথে কট্টরপন্থী ওয়াহাবি চেতনারও অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে।  কাশ্মীর যেন একটা সুপ্ত অগ্নিগিরি। আগুন লেগে আছে এই স্বর্গপুরীতে। কত মায়ের কোল খালি হচ্ছে, গুলমার্গের সবুজ উপত্যকা, ডাল লেকের নিস্তরঙ্গ জল, প্রায়ই জেগে উঠছে অশান্ত কোলাহলে।

কাশ্মীরের স্বাধীনতা সুদূর পরাহত বিষয়।হিন্দু অধ্যুষিত জম্মু, বৌদ্ধ প্রধান লাদাখ এবং উত্তরের গিলগিট-বালতিস্থান এই সকল  জাতধর্ম নিয়ে কিভাবে স্বাধীন কাশ্মীরের কাঠামো গড়ে উঠবে ইত্যাদি নিয়ে নেতাদের কোনো রূপরেখা নেই, সেই রূপ শিক্ষা দীক্ষার সুযোগ থেকে কাশ্মীরিদের বঞ্চিত রাখতেও দিল্লি সচেষ্ট।  এইটুকু রাজনৈতিক পটভূমি না দিয়ে আগানো যাচ্ছিলো না।  পুরো ভ্রমণে কাশ্মীরিদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনার উপায় ছিল না। ব্লগে পড়েছিলাম বহিরাগতদের সাথে কাশ্মীরিরা এসব আলোচনায় আরামবোধ করে না উপরন্তু আর্মি বা ভারতীয় দখলদাররাও সেটা ভালো নজরে দেখে না।

রাজনৈতিক প্রত্যেকটা ইতিহাসের একাধিক ব্যাখ্যা বা বয়ান আছে, অনেকগুলিই বিরোধী বা সাংঘর্ষিক।  স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরের জনগণের জন্য পাকিস্তান বা ভারত সরকার কতটুকু স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে সেটা নিজের চোখে দেখে, নিজের বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। কাশ্মীর এর নিয়ন্ত্রণ রেখার উভয় দিকেই অন্যায়, কাঙ্ক্ষিত ও প্রতিশ্রুত স্বাধীনতার পক্ষের গণভোট পাকিস্তান বা ভারত কোনোপক্ষই আয়োজন করে নি।  আমরা যতদিন শ্রীনগরে ছিলাম, আর্মির সশস্ত্র উপস্থিতি, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ব্যাংকার ইত্যাদি ইতিহাসকে চোখে  খোঁচা দিয়ে মনে করিয়ে দেয়। ২০১০ এ এক কিশোর প্রতিবাদকারী কে গুলি করে  হত্যা করে ভারত সেনাবাহিনী, যার ফলস্বরূপ শুরু হয় দীর্ঘকাল ব্যাপী হরতাল, সংঘর্ষ ইত্যাদি।  পরিস্থিতি মাঝে মাঝে শান্ত মনে হলেও এরই মধ্যে চলছে চোরাগুপ্তা হামলা, সেনাবাহিনী ও স্বাধীনতাকামী (মুজাহিদিন) উভয়পক্ষে মানবতা লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ।

সাম্প্রতিক কাশ্মীরি আন্দোলন এর বেশিরভাগই শান্তিপূর্ণ ও অহিংস। অপরদিকে ভারত বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য হত্যা, বর্ষণ, গুম, বিচার বহির্ভুত হত্যা ও বানোয়াট এনকাউন্টারের অভিযোগ। দুটো নির্ভেজাল তথ্য দেয়া যাক: গত বিশ বছরে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক নিহত কাশ্মীরিদের সংখ্যা অন্তত ৮০০০০ এবং এই মুহূর্তে কাশ্মীরে মোতায়েন ভারতীয় বাহিনীর সেনা সংখ্যা প্রায় ৭০০০০০! আরো বিস্তারিত তারিক আলী-অরুন্ধতী রায়ের সংকলন Kashmir: A Case for Freedom এ পাওয়া যেতে পারে। পন্ডিত নেহেরুর দুইটি উক্তি দিয়ে শেষ করা যেতে পারে:

"Kashmir has been wrongly looked upon as a prize for India or Pakistan. People seem to forget that Kashmir is not a commodity for sale or to be bartered. It has an individual existence and its people must be the final arbiters of their future. It is here today that a struggle is bearing fruit, not in the battlefield but in the minds of men" - Pandit Jawaharlal Nehru, July 1951

"It is not the property of either India or Pakistan. It belongs to the Kashmiri people. When Kashmir acceded to India, we made it clear to the leaders of the Kashmiri people that we would ultimately abide by the verdict of their plebiscite. If they tell us to walk out, I will have no hesitation in quitting." - Pandit Jawaharlal Nehru, January, 1952

উল্লেখ্য, নেহেরু জন্মগতভাবে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ বা পন্ডিত গোত্রের, তিনিও কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে পারেন নি। "কাশ্মীর ছাড়" আন্দোলন এখনো জারি আছে, ব্রিটিশ বিরোধী "ভারত ছাড়" এরই অনুরণন, ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন রূপে।

সতেরো

লাদাখ যাত্রায় ফেরা যাক।  এর পরের ক'দিন আমি আর ডাক্তার গুলশান হামলা আর লাদাখ নিয়ে টেনশনে ছিলাম। লাদাখ সম্বন্ধে এক ব্লগে পড়েছিলাম, আরামের জন্য লাদাখ নয়। এর মূল কারণ একিউট মাউন্টেইন সিকনেস বা এএমএস। পার্বত্য অঞ্চলগুলি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে হবার কারণে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন এর পরিমান অনেক কম থাকে। এর কথা প্রথম জানতে পারি এভারেস্ট বেশ ক্যাম্পের অভিযাত্রিকদের কাছে। নাগরকোটে তাশি শেরপার কাছে শুনেছিলাম বাংলাদেশি অভিযাত্রিক সজল খালেদের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ ছিল এএমএস। এএমএসের লক্ষণ হলো, মাথা ব্যাথা, বমি ভাব বা বমি, নাকে রক্তপাত, শ্বাসকষ্ট, ইত্যাদি ইত্যাদি। বলা হয় উঁচুতে অসুস্থতা যদি অন্য কোনো ভাবে প্রমাণিত না হয়, তবে ধরে নিতে হবে সেটা এএমএস।  দুই-আড়াই হাজার মিটার উচ্চতার পর থেকে এএমএস এর লক্ষণ শুরু হতে পারে। এজন্য বিধান হলো এক দিনের মধ্যে কোনোভাবেই ৫০০ মিটারের বেশি উপরে অবস্থান না করা।  বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর ব্যাপারে। যারা দীর্ঘদিন এত উচ্চতায় থেকে অভ্যস্ত তারা অভিযোজিত হয়ে যান।

সাধারণ পর্যটক দের এক্লিমাটাইজেশন (acclimatization) ঘটতে সময় লাগে।  এজন্যে ধীরে চলার ও প্রচুর পানি ও চকোলেট বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে বলে।  ২ তারিখ রাতে আমরা সে মতোই প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি। উপরন্তু ভ্রমণসঙ্গী ডাক্তার হবার সুবিধা, ডাক্তার বাংলাদেশ থেকেই এসিমক্স নামের একটা প্রতিরোধী ট্যাবলেট নিয়ে এসেছে, চড়াই এর ২৪ ঘন্টা আগে থেকে খাবার নিয়ম। আমরা শুরু করি ২ তারিখ দুপুর হতে, দুই বেলা করে।  এর পরও নিশ্চিত থাকা যায় না। একমাত্র প্রকৃত প্রতিষেধক নিচের দিকে নেমে আসা।  লেহ যে বিমান বন্দর আছে জানি, ওটাই চূড়ান্ত আস্থা। কিছু হলে সেপথে দিল্লি ভাগবো।  মুশকিল হলো শ্রীনগর - লেহ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল হাইওয়ে ১এর ৪০০ কিলোমিটার রাস্তায় দু'দিন টিকে থাকতে হবে। এর মধ্যে রাস্তায় পড়বে দুধর্ষ জোজিলা এবং দ্রাস-কার্গিল।

দু'তারিখ রাতে আমরা ঘুমানোর চেষ্টা করলাম আরাম করে।  আরেকটা পরামর্শ ছিল আমাদের মতন পর্যটকদের জন্য সেটা হলো দিনে না ঘুমানো এবং রাতে জেগে না থাকার জন্য, এই দুটিও এএমএস সংক্রান্ত। এ দুইদিনে দিনময় ছুটাছুটির ক্লান্তি রাতের ঘুমে কোনো সমস্যা করলো না।   পরের দিন  ঘুম থেকে উঠে হোটেল চেকআউট করা গেলো পাসপোর্টের ফটোকপি দিলাম রেকর্ডের জন্য। লাদাখ বা কাশ্মীর ভ্রমণে বেশ কয়েক কপি পাসপোর্টের ফটোকপি রাখা ভালো, কাজে দেয়।  পাসপোর্ট সবসময় নিজের সাথেই রাখা উচিত। এখানকার লোকজন মূলত সৎ। একটা ধাবায় ডাক্তার খাবার পর হাতের ব্যাগ (টাকাপয়সা,পাসপোর্ট সহ)  ফেলে এসেছিলো, হোটেল বয় খুঁজে পায় এবং আমাদের ডেকে ফেরত দেয়।

সকালে ধাবা ইত্যাদি খোলা দেখলাম না।  নাস্তার উপায় নেই। আসলে আগের দিন ছিল সব-ই-কদর।  সারারাত নামাজ পড়েছে সবাই। এখনো দোকানপাট তেমন খোলেনি। আমাদের দেশের মতোই মসজিদে সারারাত মাইকে সুরাপাঠ-দোয়া ইত্যাদি চলেছে। অভ্যাস বা ক্লান্তির  কারণে আমাদের ঘুমে কোন ব্যাঘাত হয় নি। সকালে নাস্তার জন্য আগে আগে উঠে গিয়েছিলাম, এখন হাতে কিছু সময় পাওয়া গেলো। একজন অটোঅলা নয় নম্বর ঘাটের কাছে আমাদের পেয়ে সাথে সাথে লেগে রইলো। অন্য যাত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা কম।  আমরা ডাল লেক কে শেষ বিদায় জানানোর জন্য কিছু ক্ষণ নির্মল বাতাসে বসে রইলাম।  এত ভোরে বাইরে পুরুষ মানুষেরা সব রুটি-রুজি বা কাজ-ধান্দায় বের হয়েছে। জগিং এর জন্যও  কয়েকজন কে পেলাম। কাছেই একটা শিখ ধর্মশালা আছে, ওখানকার লোক মনে হলো।  একটা বাচ্চা মেয়ে জুতা-মুজা পরে তার মায়ের হাত ধরে হেটে যাচ্ছে - কাশ্মীরি।

অটোওলা মানুষ ভালো।  সারা রাত নামাজের পর এখন বের হয়েছে যদি কিছু যাত্রী ধরা যায়। বাংলাদেশ শুনে খুব খুশি।আমাকে দেখে লোকজন "ইন্ডিয়ান" ধরে নেয়। সাউথের, এর আগে এক বাংলাদেশি ভাই আমাকে তামিল ঠাওরেছিলেন। অটোওলা নাম জিজ্ঞেস করলো।  বুঝতে পারলো না কিছুই। আমি বললাম, "বাংলা নাম। " পিতার নাম জিজ্ঞেস করলো এবার।  উত্তরে কি বুঝলো কে জানে! আমি বললাম, "মুসলমান নেহি হ্যায়। " লজ্জা পেয়ে উত্তর দিল, "এয়সা বাত নেহি।" এবার একটু সহজ হলো। এর পর কি করি, উপার্জন কতো, হাবিজাবি নানান প্রশ্ন। শবে কদরের মহিমাগানও হলো অল্প। পঞ্চাশ টাকায় চলে আসলাম বাস স্ট্যান্ডে, টি আর সি'র পাশে। এই সেই টিআরসি, শুরু থেকে আমাদের আশা ভরসার স্থল। কাশ্মীরিদেরও - জাতিসংঘের মিলিটারি পর্যবেক্ষক দলের অফিসের পাশে, টিআরসির মাঠে প্রতিবাদের জন্য নানা সময় জড়ো হয়।

আঠারো

আমরা বাস স্ট্যান্ডে অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাস এলো। টিকেট হাতে নিয়েও নিশ্চিত হতে পারছিলাম না আগের দিন বিকেলের ব্যবহারের জন্য। বাস দেখার পর নিশ্চিত হওয়া গেলো। তিনজন ইউরোপিয়ান, দুজন মঙ্গোলয়েড চেহারার (পরে জেনেছিলাম এরা কোরীয় পর্যটক) আর স্থানীয়, ইন্ডিয়ান অপেক্ষমান ছিল। বাস দেখতে গুলমার্গের বাসের মতোই। ডিলাক্স ইত্যাদির আশায় গুড়ে বালি। আমাদের আগের দিনে ড্রাইভার কেও দেখতে পেলাম যে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবার নিমন্ত্রণ দিয়েছিলো। তার পরিবার সম্ভবত লেহ বা কার্গিল যাচ্ছে। মাথায় কাপড় দেয়া ২ জন মহিলা, একজন তরুণী আর কয়েকটা বাচ্চা।  আমাদের টিকেটে সিট নম্বর ৯-১০। ভালোই সামনের দিকে।  দুই সারি বাদ দিয়ে। এই লম্বা যাত্রায় সিট সামনের দিকে হওয়া কত জরুরি পরে বুঝেছি। আমরা উঠে আমাদের ছোট ব্যাগগুলি সিটের নিচে আর মাথার উপরে রাখলাম। বড় ব্যাগ দুটার জন্য জায়গা নেই, পিছনের দিকে অনেক মাল পত্র।  বাসের পেটেও মাল রাখার উপায় নাই। কাউন্টারে জিজ্ঞেস করায় ছাদের দিকে ইশারা করলো। বুঝলাম ব্যাগ ছাদে যাবে। পাহাড়ি রাস্তায় ছাদের থেকে ব্যাগ ছুটে না গেলে হয়।  যাই হোক।  হেল্পার বা ড্রাইভারের অপেক্ষা করতে লাগলাম ব্যাগ ছাদে তোলার জন্য। কিন্তু কই ? কারো নাম গন্ধ নাই।  এর মধ্যে একটা ইউরোপিয়ান (পরে জেনেছিলাম ছেলেটা ইতালীয়) নিজে নিজেই ব্যাগ ছাদে রেখে আসলো। ওকে দেখেও আমি উঠে গেলাম ছাদে। ব্যাগ রেখে একটা গিট্টু দিয়ে ছাদের রেলিং - গ্রিল এগুলির সাথে বেঁধে দিয়ে আসলাম যাতে না খুলে যায় (এটা না করলেও হতো, ত্রিপল দিয়ে পরে ঢেকে দিয়েছিলো)। একে একে বাকি দুই ইউরোপীয় (চেক রিপাবলিকান), আর দুই দক্ষিনি (অন্ধ্রের লোক) তরুণ যার যার ব্যাগগুলি রেখে আসলো ছাদের উপর।


বাসে বসার পর বুঝলাম আমাদের ঠিক সামনের সিটে বসেছেন দুই বাঙালি ভদ্রলোক। একজনে র নাম শান্তি দা, তার পাশের সিটে ভদ্রলোকের শ্যালক। শান্তিদা একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন। দুজনের কথা বার্তায় টের পেলাম তারা এক বৃহৎ পরিবারের মাত্র দুইজন আগে এসে বসেছেন, বাকিরা পথিমধ্যে উঠবেন। বাস চলতে শুরু করলো। বুলেভার্দের কাছে ডানে ঢুকে থেমে গেলো এক হোটেলের কাছে, শান্তিদার বর্ধিত পরিবার কে তুলবার জন্য। এই ফাঁকে আমি আরো কয়েক বোতল পানীয় জল (লাদাখের রাস্তায় যত বেশি জল খাওয়া যায়) আর চকোলেট কিনে আনলাম।বাসে উঠে দেখি তুলকালাম কান্ড। বর্ধিত পরিবারের বাকী সদস্যরা উঠেছেন, কিন্তু বসতে পারেন নি।  এর মধ্যে বাস চলতে শুরু করেছে।  পরিবারের সদস্য: শান্তিদা ও তার স্ত্রী (দিদির নাম জানলে ভালো হতো, উনি ধন্বন্তরি টাইপের, অন্তত ঐশ্বরিক বা আসুরিক একটা ব্যাপার-ফ্যাপার আচে),  পুত্র তন্ময় ডাকনাম তনু (তরুণ ১৮-১৯ বয়স, ভাবখানা পৃথিবীর আমাকে ছাড়া চলবে না), শ্যালক, শ্যালকের স্ত্রী, শ্যালকের পুত্র লাল্টু (বয়স ৯-১০, ভাবখানা ছুটি গল্পের মাখন), শান্তিদার ভায়রা (উনি বয়সে বৃদ্ধ কিন্তু আচরি যুবক, কিশোরও বলা যায়, ঘন্টায় ঘন্টায় বিড়ি ফুঁকেন আর যার তার প্রতি  যা তা মন্তব্য ছুঁড়ে দেন) ও  তার স্ত্রী (বৃদ্ধা, লাঠি ভর করে চলেন, কিছুতেই সন্তুষ্ট নন), আরেকজন বৃদ্ধা আত্মীয় ও একজন মহারাজ (ইনি পাঁচক, হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবার পাঁচক নিয়ে চলবে তাতে নাক-চোখ কচলানোর কি আছে)!

আমি বাসে উঠেই দেখি উনাদের ছোট পরিবারের ব্যাগপত্র মালসামান রাখা নিয়ে এক প্রস্থ হুলুস্থূল। শুধু ব্যাগপত্তর হলে হতো, সাথে আছে ডেকচি ও বাসন কোসন। হাবে-ভাবে মনে হচ্ছিলো  অমরনাথের দল, কিন্তু আমাদের ভুল প্রমান করে লেহ পর্যন্ত আমাদের যাত্রার বিনোদন ও নিরাপাত্তা বিধান করে বাধিত করেছিলেন। ব্যাগ - ডেকচি সব ছাদে তুলে দিয়ে তাদের হিন্দুস্তানি এজেন্ট তথা দালাল পালালো। এবারে বসার পালা।  শান্তিদার বৌ মানে তনুর মা, আক্ষরিক অর্থে ক্যাচ ক্যাচ শুরু করলেন, সিট পছন্দ না।  হটাৎ কি হলো, হাতের ব্যাগ-বস্তা ছুড়ে দিলেন শান্তিদার উপর, রগড়াতে রগড়াতে পিছনে যেতে যেতে বলতে লাগলেন, "আমি কিন্তু বমি-ফমি করে সব ভাসিয়ে-ফাসিয়ে দিব।" তাদের ছেলে তন্ময়ও বিরক্ত, দুদিন নষ্ট করে লেহ যাবার লোক সে না।  সে "নেবে যাব, উল্টো বাস নেব, বসবই না", দাঁড়িয়েই থাকলো পরের স্টপ কঙ্গন পর্যন্ত। সব দোষ শান্তিদার, ঠিক মতন টিকেট করতেও পারে না।  শান্তিদা তখন যুক্তিমান ও ধৈর্য্যবান বাঙালি।বাকি সবকটা লোক শান্তিদাকে ধুচ্ছে। আমাদের ড্রাইভার রফিক ভাই বিরক্ত। এই করেই শ্রীনগর-কঙ্গনের ৪০ কিলোমিটার রাস্তা কেটে গেলো।  পথ হযরতবাল মসজিদের পাশ দিয়ে, অর্থাৎ ডাল লেক পুরোটা ঘুরে। পথে সবুজ ভ্যালি, একটা চমৎকার পদ্মপুকুর চোখে পড়ল।  দুপাশে ছোট্ট নালা দিয়ে ঝর্ণার জল বয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই আর্মির উপস্থিতি, তেমন লোকজন নেই এই পথে।  প্রথম বিরতি কঙ্গন, সকালের নাস্তা ইত্যাদি।

ঊনিশ

কঙ্গনের বিরতিতে আমরা একটা ধাবাতে খেতে বসলাম। কঙ্গনের উপত্যকায় অনেক মানুষের বাস মনে হলো। আলু পরোটার পর চা।  আমার ভ্রমণ সঙ্গী ডাক্তার চা খাচ্ছে দেখে শান্তিদার ভায়রা আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে খাস বাংলাতে বলতে লাগলেন, "দেখছিস কালুটা (আমি তামিল) জাপানিটাকে (ডাক্তারের মঙ্গোলয়েড চেহারা!) কেমন শিখিয়ে পড়িয়ে ফেলেচে, দিব্যি আমাদের মতোন করেই চা খাচ্ছে!" আমি আর ডাক্তার স্তব্ধ। উনি ভেবেছেন জাপানি বাংলা বুঝবে না, তামিলও না।  পরের দু'দিন লজ্জায় উনাদের আশপাশে থাকাকালীন আর বাংলা জবান মুখে আনিনি। পাহাড়ি অনেক কুকুর দেখলাম।

কঙ্গনের খানিক আগে থেকে রাস্তার দুধার দারুন সুন্দর হতে শুরু করেছে।  রাস্তার পাশ ধরে সিন্ধু! এই সেই সিন্ধু নদ ! মানস থেকে বের হয়ে লাদাখ-কাশ্মীর চিরে পাকিস্তানের পাঞ্জাব-সিন্ধু প্রদেশ হয়ে আরব সাগরে পড়েছে। মরু-পাকিস্তানের লাইফলাইন (লাদাখেরও)।  এখানে বেশ খরস্রোতা।  নদীর ওপারে পাহাড়ি উপত্যকা, কোথাও গ্রাম, কোথাও বন, ক্ষেত খামার, দারুন সবুজ, এর পর সবুজ পাহাড় উঠে গেছে উপরের আকাশের দিকে, পাহাড়ের গায়ে অনেক গাছপালা। ধানক্ষেত দেখলাম বেশ কিছু।  কোথাও আবার সবুজের চূড়ায় শ্বেত-শুভ্র মুকুট।  এখন থেকে  বালতাল পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিলোমিটার মতন রাস্তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ডানদিকের দুর্দান্ত সিন্ধু। আশেপাশের সবকটা পাহাড়ের খাঁজ থেকে বরফ গলে ঝর্ণা পড়ছে তার নীল জলে, আরো বেগবান হয়ে ছুটছে সবুজের বুক চিরে। বলতালের আগে সোনমার্গ। এখন থেকে চড়াই এর শুরু।

সোনমার্গের নাম অনেক শুনেছি। বড়সর সেনা ক্যাম্প। ব্যাটালিয়ান -ডিভিশন এ ধরণের কিছু একটা হবে। হ্যালিপ্যাড আছে, এক জায়গায় অমরনাথ যাত্রীদের স্বাগতম জাতীয় কিছু একটা লেখা ব্যানার, তার পাশ দিয়ে রাস্তা সিন্ধুর তীর ঘেঁষে আরেকদিকে গেছে। আমরা উপরে উঠতে শুরু করলাম। এই রাস্তা এখন উঠতে থাকবে জোজিলার দিকে। একটু উপরে উঠতেই চোখে পড়লো নিচে সিন্ধুর পাড়ে জড়ো হওয়া অমরনাথ যাত্রীদের ক্যাম্প। অসংখ্য ছোট-ছোট লাল-নীল-হলুদ তাবু আর হাজার হাজার গাড়ি। এই পর্যন্ত গাড়ি করেই আসা যায়, এখানে বিরতি, এর পরে থেকে, পায়ে হেটে, টাট্টু চড়ে কিংবা হেলিকপ্টারে করে যেতে হবে অমরনাথ। অনেকগুলি হেলিকপ্টার আসা যাওয়া করতে দেখা গেলো অল্প সময়ের মধ্যেই। শান্তিদার বৌ এ ব্যাপারগুলি সব আগে শুনেছেন, দেখেছেন, জানেন ও বোঝেন, উনি ধারাভাষ্য দিতে থাকলেন শুদ্ধ বাংলায় (চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে), কোরিয়-ইতালিয়ান-চেক-মঙ্গোল-তামিল সবাইকেই তা জোরপূর্বক শুনতে হলো, না শুনে উপায় নেই।


অমরনাথ হিন্দুদের একটা অন্যতম প্রধান ও দুর্গম তীর্থস্থান। পাহাড়ের উপরে গুহায় প্রাকৃতিকভাবে শিবলিঙ্গ আকৃতির এক পাথর, আর তারই সেবায় দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হয় হিন্দু পুণ্যার্থীরা।  অমরনাথ যাত্রা তিন দিক থেকে করা যায়: গুরুত্ব অনুসারে পেহেলগাম, সোনমার্গ অথবা বলতাল। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে গড়ে পাঁচলক্ষ হিন্দু অমরনাথ ভ্রমণ করে, আগে এই সংখ্যা ছিল বছরে মাত্র বিশ হাজার। এই হঠাৎ বৃদ্ধির পিছনেও আসল কারণ হিন্দু জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী উত্থান। ২০০৮ এ হঠাৎ কাশ্মীরের এই ভূমি সরকার অমরনাথ যাত্রা বোর্ড কে দিয়ে দিতে চায়,  ইসরায়েলি কায়দায় (কাশ্মীর বিষয়ে ইসরায়েলের বুদ্ধি ও অস্ত্র দুই সাহায্যই ইন্ডিয়া গ্রহণ করে থাকে, সময় অসময়ে ইসরায়েলি জেনারেলরা ভ্রমণ ইত্যাদি করে যান, এই পর্বে রাজনীতি পেঁচাল একটু বেড়ে যাচ্ছে)।  প্রতিবাদের মুখে সে যাত্রা ফিরে এলেও জম্মুর উগ্র হিন্দুরা এখন উল্টা গন্ডগোল পাঁকানো শুরু করেছে।  মোদ্দাকথা এই তীর্থযাত্রা এখন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় লক্ষ্য সিদ্ধ করে।

অমরনাথ গুহা প্রথম খুঁজে পায় কিন্তু কাশ্মীরি মুসলিম রাখালেরা ভেড়া চড়াতে গিয়েই। মনে পড়লো নমিতা মাসির কথা, সেই ছোট বেলা তার কাছে অমরনাথের এই খোঁজ-কাহিনীর গল্প শুনেছিলাম। খোঁজ-কাহিনীর অসাম্প্রদায়িক জায়গাটা বর্ণনার সময় মাসির যে মুখটা হতো তা মনে পড়লো। সেই মুখের নির্মলতা আজীবন কৃতজ্ঞতাপাশে বেঁধে রাখবে আমার ভিতরকার "মানুষ"টাকে।  অরুন্ধতী রায়ের লেখায় পড়েছিলাম, ২০০৮ এর ভীষণ প্রতিবাদের সময় মুসলিম প্রতিবাদী কাশ্মীরিরা কিভাবে পাঁচ লক্ষ অমরনাথ যাত্রীর উপর একফোঁটা আঁচড়ও লাগতে দেয় নি, অথচ চালিয়ে গেছে কঠোর প্রতিবাদ, নিজের ভূমি রক্ষায়। জুলাই-আগস্ট অমরনাথের জন্য সু'দিন।  ২০১৬ এর যাত্রা শুরু হয়েছে জুলাই এর ২ তারিখ মানে আগের দিন থেকে।


বিশ

তিব্বতি বা লাদাখি ভাষায় "লা" শব্দের অর্থ গিরিপথ বা মাউন্টেন পাস (mountain pass)। বালতালের পর থেকে শুরু দুধর্ষ জোজিলা। উচ্চতা সাড়ে তিনহাজার মিটার। পথ পাথুড়ে, স্থানে স্থানে পাথর পরে আছে বড়-ছোট-মাঝারি আকারের, কোথাও কোথাও একটা গাড়ি কোনোমতে যেতে পারে, একটু বেকায়দা হলেই দেড় হাজার মিটার নিচের সিন্ধুপাড়ের  অমরনাথ যাত্রীদের ক্যাম্পের কাছে গিয়ে পড়তে হবে, সোজা ভগবানের পদপ্রান্তে গিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ হবে।  একটা গাড়ি এক দিক দিয়ে আসলে অন্যরা থেমে পথ দেয়, এখানে কারো তাড়াহুড়ো নেই।  বাস নেয়াতে ভালো হয়েছে, ছোট ছোট জিপ আর টয়োটা ইনোভাগুলিকে দেখে ভয় হতে লাগলো। এর মধ্যে দেখি একদল টাট্টু করেই আসছে, যাচ্ছে। মোটরবাইকওয়ালাও আছে এই পথে, তবে সংখ্যায় কম। অমরনাথ ক্যাম্প দেখতে দেখতেই আমরা জোজিলাতে উঠতে থাকলাম।  একটা বড় পাহাড়ের গা বেয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে রাস্তা উপরের দিকে উঠেছে এবং এক সময় সেই পাহাড়কে ডিঙিয়ে ওপাশে যাবে। ডাক্তার বসেছিল জানালার ধারে, তার চেহারা দেখে মনে হলো নরকের কিনার দিয়ে যাচ্ছে।  পথিমধ্যে ক্বচিৎ পাহাড়ি ঝর্ণা, আসলে পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে বরফ গলা পানির স্রোত, রাস্তার উপর দিয়ে একফুট-আধফুট মতন পানির তোড়, এসব জায়গায় বাস খুব ধীরে সাবধানে চলে।  


জোজিলা টপ বা উপরে অনেকেই গাড়ি থামিয়ে ফটো ইত্যাদি তুলছে, জোজিলা পার হয়ে ওপাশের পাহাড়ে যেতেই দৃশ্যপটে আমূল পরিবর্তন! এপাশের সবুজ যেন কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। পাহাড়ের গায়ে ঘাসের হালকা আস্তরণ আছে, কিন্তু  গাছ-গাছড়া উধাও। সামনের কদিনে এই সবুজের মাত্রা কমতে কমতে মরুভূমি হয়ে যাবে। লাদাখ হিমালয়ের বুকে এক হিমশীতল মরুদেশ। বরফিলা একটা উপত্যকা পাওয়া গেলো, মানুষজন মহানন্দে স্কী, স্লেজিং করছে। এখন থেকেই শুরু লাদাখ- কারগিলের রাস্তা। সবুজ পাহাড় ধুসর হতে শুরু করলো বলে, সিন্ধু নদ অমরনাথের ওদিকে, পাহাড়ের এপাশে তার দেখা নেই।    মিনমার্গ নামের একটা জায়গায় থামলো, কার্গিল ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের একটা পুলিশ চেক পোস্ট, বিদেশিদের নিবন্ধন করতে হলো, খুব বেশি ঝামেলা নেই।  একটা পাবলিক টয়লেটের দেখা পেলাম, অর্গানিক, লাদাখী স্টাইল, কিন্তু তার মধ্যে অনেক প্লাস্টিক বোতল! দ্রাস খুব দূরে নয় আর।  সবুজের সাথে সাথে তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতি দ্রাসে।

দ্রাস ভারতের সবচেয়ে ঠান্ডা জায়গা, ৩২০০ মিটার উঁচুতে। ছোট শহর, শীতের সময় গড় তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে উঁচু পার্বত্য এলাকায় এক ধরণের হলুদ গোলাপ ফোটে প্রতি গ্রীষ্মে। এলাকার মানুষ এই গোলাপের পাঁপড়ি খায় এবং তারা বিশ্বাস করে এতে দেহ ও মনের পুষ্টি সাধন ঘটে।  আমরা অবশ্য খাবার সারলাম চাপাতি, রাজমাহ (শিম জাতীয় ডাল) আর সবজি দিয়ে, সাথে চা।  খেতে খেতে কথা হলো দুই চেক প্রজাতন্ত্রীর সাথে।  তাদের দুইজনের নামই ইয়ুর্গি (ইংরেজিতে জর্জ)। দুইজনের সাথেই স্লিপিং ব্যাগ, ট্রেকিং স্টিক, বয়স চল্লিশের উপরে হবে, স্তোক কাংড়ি (লেহ থেকে কাছের একটা সহজগম্য শৃঙ্গ - ৬১৫৩ মিটার) তে উঠার ইচ্ছে আছে তাদের। এরা দেশ-রাজীনীতির খবর কিছুই রাখে না, ঢাকার খবরও জানে না বোধ হয়। বাঙালি বৃহৎ পরিবার দোকানে ঢুকে হৈ হুল্লোড় লাগিয়ে দিলো। ঠিক কেন তা বোঝা গেলো না, চা এর চিনি কিংবা টয়লেটের নোংরা, কোনো একটা হবে।   


দ্রাস এর পর থেকে কার্গিল পর্যন্ত রাস্তা উত্তম, পিচঢালা-মসৃন ও নিরাপদ। রাস্তার দু'ধারে ধূসর প্রায় পাহাড়। দ্রাস ওয়ার মেমোরিয়াল পড়লো বাম দিকে। ১৯৯৯ এর গরমে পাকিস্তান এই দ্রাস কার্গিলেই অনুপ্রবেশ করে এবং যার ফলস্বরূপ কার্গিল যুদ্ধ। মাঝে কাকসার এর কাছে আস্তে আস্তে এবার বাম দিকে নদী পেতে শুরু করলাম - দ্রাস রিভার। কিছুদূর পর দ্রাস আর সিঙ্গুর মোহনা থেকে সুরু নদী।  এই কার্গিল বা সুরু উপত্যকার শুরু। ডাক্তারের একটু ঝিমুনি এসেছিল।পানি খাইয়ে আর দিনে ঘুমানোর অপকারিতা সম্বন্ধে দু-চার লাইন শুনিয়ে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করা গেলো।  শান্তিদার স্ত্রীও কোরিয়ান দম্পত্তির সৌজন্যে সামনের সিটে এসে বসেছেন এবং মহাসুখে কেউমেউ চালিয়ে যাচ্ছেন, বাকীরা ঘুমে বিহ্বল।


 একুশ

আমরা কার্গিল পৌছালাম বিকেল চারটার পর। শিয়া প্রধান এলাকা। ড্রাইভার রফিক ভাই জানালেন পরের দিন ভোর পাঁচটার সময় বাস ছাড়বে একই জায়গা থেকে লেহর দিকে।  কেউ যাতে কোনো দেরি না করি। হুসেইনি পার্কে বাস থেকে নামলাম আমরা। পার্কের গেটে খোমেইনীর ছবি। হোটেলের নাম মর্জিনা। সস্তাই হলো। এখানেও চব্বিশ ঘন্টা বিদ্যুৎ, গিজারে গরম জল, আধুনিক টয়লেট। আমাদের দুপাশের রুমে দুই জর্জ আর ইতালিয়ান ছেলেটা। বাকিরাও যার যার মতন নানা জায়গায় উঠে গেলো। একটু ফ্রেস হয়ে শহর দেখতে বেরুলাম। দুইপাহাড়ের গায়ে অনিন্দ্য কার্গিল আর  মাঝ দিয়ে গেছে সুরু নদী। প্রচন্ড স্রোত সে নদীর।

শহরের মূল রাস্তা, যেটা ট্যুরিস্ট রিসিপশন সেন্টার থেকে লাল চকের দিকে গেছে, সেই বরাবর আমি আর ডাক্তার হাঁটাহাঁটি করলাম।  ব্লগে পড়েছিলাম এখানে ভেজিটেরিয়ান পাওয়া মুশকিল, আমাদের তাতে কোনো আপত্তি ছিল না।  বিকেলের বাজার বসেছে, শাক-সবজি-ফলমূলের পাশাপাশি শীতের কাপড় বিক্রি হচ্ছে: মুজা-সোয়েটার-টুপি। একটা সাইবার ক্যাফে পাওয়া গেলো, সেলুনে শাহরুখ খান কেও দেখা গেলো (শ্রীনগরে কোথাও নেই বা দেখি নি তাকে)। এখানকার মানুষের চেহারা কাশ্মীরি নয়, বরং লাদাখি বা দরদিস্তান এর লোকেদের মতন। গরম সসেজ বিক্রি হচ্ছে কাবাবের মতন করে, খেতে ইচ্ছে না হলেও ছবি তুলতে ইচ্ছা প্রকাশ করায় বিরক্ত বিক্রেতা ছেলেটা, ওকে ছেড়ে এক কুল বিক্রেতাকে পেলাম।  তার কাছে এক পোয়া কুল কেনা হলো চল্লিশ টাকা দিয়ে।  সুরু নদীর উপর একটা ব্রিজ, সেটা পার হয়ে অন্য পাহাড়টার দিকেও অল্প গেলাম। কার্গিল কিংবা কাশ্মীরে মেয়েরা পর্দা করে, খোলাও বেড়ায়, উভয়ই কৃত্রিমতা বর্জিত, আমাদের ঢাকার মতন না। চারদিক টা খুব সুন্দর, প্রচুর এপ্রিকট, চেরি আর পাহাড়ি ফুলের গাছ, খুব কাছেই পাকিস্তান এর নিয়ন্ত্রণ রেখা, কাছাকাছি পাকিস্তানি বড় শহরের নাম স্কার্ডু। সন্ধ্যের আগেই হোটেলে ফেরা গেলো।
(চলবে)