Monday, November 08, 2010

মৃত্যুঞ্জয়ের এক দিন

গতকাল সন্ধ্যায় চুল কেটেছিলাম। রাতে গোসল করেছি। গাল কেটে ফেলার ভয় ছিল, তাই শেভ করা হয় নি। একটা হাফ শার্ট গায়ে বের হয়ে গেলাম। লিপি আসছে। স্টেশনে যেতে হবে। মোবাইল ফোনটাতে কতগুলি মিসড কল জমা হয়ে আছে। সাড়ে ছয়টা থেকে শুরু করে।

ছয় নম্বর বাস। শুক্রবার সকাল। মালিবাগের মোড়ে আজকে জ্যাম নেই। আরেকটা কল।

-হ্যালো, কোথায়?

-তেজগাঁও।

-আমি মালিবাগ।

-ঘুমাচ্ছিলে? কাল রাতেও?

-অল্প।

-রাতেই টের পেয়েছিলাম।

-তুমি তো সবই টের পাও।

-আচ্ছা, রাখো।

রেলওয়ে হাসপাতালটা পার হবার পর হালকা একটু বমিভাব হলো। স্টেশনে এসে গোল্ডলীফ ধরালাম একটা। অর্ধেকটা খাওয়া গেলো।

আজকে রিটার্ণ ট্রেণ সাড়ে পাঁচটায়। লিপিকে প্রায় দু’মাস পর দেখছি। ছোট একটা ট্রাভেল ব্যাগ কাধে।

-আমাকে দাও।

-আমার কাছেই থাক। খেয়েছো কিছু?


রিক্সা নিলাম। কোথায় যাওয়া যায়? পার্ক? সিনেমা? চুমু খাবার জায়গা পর্যন্ত নেই। ধুর।

-জীবনের ওখানে যাবে?

-না।

-সারাদিন কি করবে বলো?

-সায়েদাবাদ চলো। বাসে তুলে দাও। ফেরত চলে যাই।

লিপি নিজেই চলে যেতে পারে বাসে উঠে। ওর হাতটা ধরতে ইচ্ছে করে। কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে ইচ্ছে করে। রাতে দুই গ্লাস কেরু গিলেছিলাম। মাথা ধরা আছে। রাতে ফোনে কি বলেছিলাম মনে পড়েনা। আমার পাশে লিপি। দুজন রিক্সায়। পল্টনের মোড়। সিগন্যাল। লাল বাতি। পাশে একটা বাস। একটা ছেলের হাতে ভুট্টাভাজার প্যাকেট। চিল্লাচ্ছে, “পাপন! পাপন!”

ছেলেটা বাস থেকে নেমে যায়। সিগন্যাল ছাড়লো। আমি লিপির দিকে তাকালাম। রোদটা কড়া। ওর চোখ অন্যদিকে। হঠাৎ চমকে উঠলো। লিপি রিক্সা থেকে নেমে যাচ্ছে। আমি বাসটার সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি ছেলেটা পড়ে আছে। মাথাটা রাস্তার উপরলাল রঙের একটা সরু রেখা টলটল করতে শুরু করলোআমিও নামলাম।

-একটা সি এন জি বা ট্যাক্সি ডাক!

ভিড়ের মধ্যেই একজনকে পেলাম। লোকটা কেমন ইতস্তত করছে। লিপি বলে উঠলো,

-আমি আপনাকে ভাড়া দেবো।

-ম্যাডাম, এরা এমনই।

-একটু তুলে দিন না ধরে।

কয়েকজন এগিয়ে এলো। ধরে ছেলেটাকে তুলে দিল সি এন জি’র মধ্যে। “ম্যাডাম” সম্বোধনকারী আর লিপি উঠে গেলো পিছনে।

-ঢাকা মেডিক্যাল চলুন। এই! তুমি কি করছো? সামনে বসো।

সি এন জি চালক আমার দিকে একটা অবজ্ঞার দৃষ্টি দিল বোধহয়।



ইমার্জেন্সী থেকে বের হবার পর দেখলাম, লিপির জামায় রক্তের দাগ। পুলিশ সার্জেন্ট লিপির ঠিকানা লিখে নিল। আমার নাম, আমি কি করি, তাও জিজ্ঞেস করেছিল। আমি কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। ম্যাডাম সম্বোধনকারী লোকটা কাছে এসে দাড়ালো। আমি না থাকলে লোকটা মনে হয় খুশি হতো।

-আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

-আমার নাম সুজন।

-আপনি খুব ভালো মানুষ।

-আপনার মতন না!

-কেন? আমি মেয়ে বলে?


আমি ভাবছিলাম, আমি কোথায়? লিপির কাপড় নষ্ট হয়ে গেছে। আমি না থাকলে সুজন আর কি কি বলতো কে জানে। লোকটা লিপিকে “ম্যাডাম” সম্বোধন করলো কেন? এটাই মনে হয় সহজ। আমার সাথে লিপির প্রথম দেখা কোথায়? কলেজে। আমি কি ওকে “ম্যাডাম” ডেকেছি কোনদিন? আচ্ছা কলেজে দেখা না হয়ে যদি অন্য কোথাও দেখা হতো, তাহলে? বা এই ব্যাটা সুজনের জায়গায় আমি থাকলে আমি কি “ম্যাডাম” বলতে পারতাম? ইচ্ছে হলো সুজনকে জিজ্ঞেস করি।


-
তুমি ওরকম করছিলে কেন?
-
কি রকম করছিলাম, ম্যাডাম?
-
ম্যাডাম?
-
ডাকতে ইচ্ছে হলো।
-
ওসব ছাড়ো। আমি কাপড় পাল্টাবো, জীবনদার মেসে চলো।





ট্র্যাভেল ব্যাগের থেকে কাপড় নিয়ে পাল্টালো লিপি। ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে
, ব্যাগের মধ্যে কাপড় নিয়ে ঘোরে কেন? জীবন একটা টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করে। লিপিকে খুব পছন্দ করে। দুজনে শুটিংয়ের গল্প জুড়ে দিল। আমি ভাবতে লাগলাম, জীবন আর লিপি রিক্সায় ঘুরছে, আর বাদামের খোসা ছড়াচ্ছে। অথবা সুজনের সাথে লিপি। নাহ। জীবনই ভালো। সুজন একটা উটকো ঝামেলা। লিপিকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

জীবন রান্না করলো। লিপি সাহায্য করছিল। মেসের বাসিন্দা তিনজন। বাকিরা গতকাল বিকেল থেকেই নেই
লিপি আসবে এটা জীবন জানতো। আমাকে জানিয়ে রেখেছিল। জীবনের মেসের চাবি আমার কাছে থাকে সবসময়আমার মাথা ধরাটা বাড়ছিল। আবার একটা সিগারেট ধরালাম বারান্দায় গিয়ে। রোদটা এখনো কড়া।

বাসাটা পাঁচতলার উপর।নিচে কিছু টিনশেড। রাস্তার উপরেই ডাস্টবিন। পাশে একটা নারিকেল গাছ। মসজিদ থেকে লোকজন বের হয়ে আসছে। লিপির বাবা কেমন আছে, জিজ্ঞেস করা হয় নি।

-
বাবার শরীর আগের মতই
-
আমি কি একটা ফোন করবো ?
-
বিকেলে চলো আমার সাথে, দেখা করেই আসবে।

লিপি সহজে রাগ করে না। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না সত্যিই যাবো কি না। জীবন সাহায্য করলোঃ

- কি বলে এসেছো বাবাকে?

লিপি একটু হাসলো। লিপি মিথ্যা বলে না। জীবন জানে। সেও হাসলো। আমার ইচ্ছে হলো লিপিকে একটু আদর করি। মাথাটা ধরে এলো আবার, কিছুই খেতে পারলাম না। ঠান্ডা জল খেলাম বেশি করে। সকালে আরো ঘুম দরকার ছিল।


জীবনের মেস থেকে বেরিয়ে এসেছি। এখনো রোদ কমেনি। রিক্সা নিলাম। লিপিকে বাসেই তুলে দেবো। আমি কি ওর বাবাকে দেখতে যাব? ওর সাথে বাসে উঠে গেলে কেমন হয়? ও যদি না করে, তখন না হয় ফিরে আসবো।

রিক্সার হুডটা তুলে দিল লিপি। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। রিক্সা আরামবাগের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। জীবন একটা ঠান্ডা জলের বোতল দিয়ে দিয়েছে।

- ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছিলো কে?

- রিফাত।

- ওর পড়ালেখা কেমন হচ্ছে?

- হচ্ছে। তুমি একদিন দেখা করে যেও ওর পরীক্ষার আগে।

- আজকে যাই?

- আমার জন্য না, রিফাতের জন্য। আর বাবাকে দেখতে যাবার দরকার নেই এখন।


রিফাত লিপির ছোট ভাই। রোদটা এখন একটু কমে এসেছে। হুড নামিয়ে দিলাম। হালকা একটা বাতাস বইতে শুরু করেছে। আজকের দিনটা কেমন গেলো লিপির ? ট্রেনে উঠেছে সেই সকালে। শুক্রবারের ট্রেনে ভিড় কিছু কম থাকে অবশ্য। সকাল থেকে অন্তত দশটা কল আমি ধরি নি। হয়তো রাস্তায় কোথাও সমস্যা হয়েছিল। বা ট্রেন কোথাও আটকে গিয়েছিলো। অথবা হয়তো আমাকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্যই বার বার কল দিচ্ছিল। এখন বাসে তুলে দিয়ে চলে আসবো। বাসায় যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে নিশ্চিত। আমার মাথা ধরাটা চলে গেছে প্রায়। রিক্সা সায়েদাবাদের কাছাকাছি। লিপি আমার হাতটাকে ওর হাতের মুঠোয় নিল।


আগে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে একটা গল্প লেখার ইচ্ছে ছিল| লেখা হয় নি| গতকাল ঘুম আসছিল না| লিখতে শুরু করলাম| কিন্তু অন্য কাউকে নিয়ে লেখা হয়ে গেল| নামটা বদলানো হয় নি| পুন:লিখন করব কোনোদিন সময় পেলে|

( ৭ ই নভেম্বর, ২০১০)






No comments: