Sunday, July 04, 2010

নিজামীর ফাঁসি চাই

প্রথমেই আহমদ ছফার একটা উক্তি দিয়ে শুরু করি, “আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন শুধু আওয়ামী লীগ জেতে, যখন হারে তখন সারা দেশ হারে”। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক যেদিন ছফা এটি বলেছেন সেদিন থেকে শুরু করে, এখন পর্যন্ত। আরো কিছু দিন হয়ত এর উপযোগিতা থাকবে, অন্তত যতদিন আওয়ামী বিরোধী শক্তিগুলি জনগনকে হারাতেই থাকবে। এটাই আওয়ামী লীগের বড় শক্তি এটাই আওয়ামী লীগের বড় দুর্বলতা। বিএনপি-জামাত ও অন্যান্য পার্টিগুলির সুযোগও এখানেই। ৭৫ এর পরে যারা নানা কায়দা কৌশলে ক্ষমতায় এসেছে ও রাজনৈতিক পরিচয় লাভ করেছে সবাই ঐ আওয়ামী বিরোধিতার সূত্র ধরেই, নয়ত এই সবগুলি পার্টির মূলে পাই শুধু সুবিধাবাদ। আওয়ামী লীগ যতদিনে এই দোষে দুষ্ট হয়ে পঁচে না যাচ্ছে অথবা অন্য কোন বিকল্প গড়ে না উঠছে, ততদিন জনগণের আশা এই দুষ্ট আওয়ামী লীগেই। যার পরিচালনায় নেই গণতন্ত্র, অথচ আমরা গণতন্ত্রের ভার সেই আওয়ামী লীগকেই অর্পণ করেছি।

গত নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে বলে অনেকেই মনে করেন। আমিও তাদের দলে। এর ফলে অনেকগুলি ইস্যু পাশ কাটিয়ে যাওয়া গেছেঃ স্বৈরাচারের সাথে আঁতাত, ধর্ম, পূর্ববর্তী সন্ত্রাস ইত্যাদি ইত্যাদি। বিকল্প না থাকা টা যে বড় কারণ এটা আগেই বলেছি, এর উল্লেখ আর করছি না। আমি মূল দুটি বিষয় নিয়ে থাকবো। এক যুদ্ধাপরাধী বিচার, দুই ধর্মীয় রাজনীতি। আশ্চর্যভাবেই এই দুটি বিষয় অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িত, কারণ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও খোদ আওয়ামী লীগ।

বেশি দূরে যাবার দরকার নেই। ২০০৬ এর বাতিল করা নির্বাচনের ঠিক আগে, যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন পত্রও জমা দিয়েছিল, তখন পত্রপত্রিকা জুড়ে ফলাও করে একটা খবর ছিল, তা হলো খেলাফতে মজলিশ নামের এক পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী আঁতাতের চুক্তি। শেখ হাসিনা নিজের রাজি ছিলেন সেই চুক্তি বাস্তবায়নে, যার মূল কথাগুলি জামায়াতের শ্লোগানের সাথে অভিন্নতা প্রকাশ করে। পড়ে নানা চাপে এবং জনস্রোত অনুকূলে, এটা বুঝতে পেরে আওয়ামী লীগ ওটা বাতিল করে। ভুল বুঝতে পারে এটা বলা ভুল। সম্ভবত বুঝতে পারে যে আপাতত ওটার দরকার নেই। তবে ওটার প্রয়োজন তার এখনো রয়ে গেছে। ধর্ম বিষয়ে আওয়ামী আগেও মার খেয়েছে। তাই সে ভোলেনি। ২০০১ এর নির্বাচনের আগে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেসব কুৎসা রটিয়ে পোস্টার ছাপা হয়, তার দিকে তাকালেই বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটা উদাহরণ দেই। বিশ্বভারতীর অনুষ্ঠানে ইন্দ্রকুমারগুজরাল ও হাসিনা উপবিষ্ট। দুজনের গলায় ফুলের মালা কপালে আবীর। ইঙ্গিত কুরুচিপূর্ণ এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী। এরকম আরো কিছু পোস্টার, তখনকার আওয়ামী বিরোধী মহল সযত্নে ছাপিয়েছিল। এবং আমার ধারণা সেটার কার্যকারীতাও ছিল। প্রমাণ নির্বাচনের ফলাফলে। তাহলে ওটার যে কার্যকারিতা আছে তা আমি যেমন বুঝি আওয়ামী লীগও বোঝে। আর বোঝে বলেই এটা নিয়ে সে ভীত ও উদগ্রীব, মাঝে মাঝে এটাকে নিজের পক্ষেও কাজে লাগাতে চায়।
এই তো সেদিনের কথা। জিয়া’র নাম বদলে রাখা হলো, “হযরত শাহজালাল”। আওয়ামী লীগ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করতে চায়, সে ইসলামের শত্রু নয়। সে ইসলামকে ধ্বংস করবে না। কেন দরকার হয়? আমাদের দেশে যেখানে পাঁচটি মৌলিক চাহিদাই ঠিক মতন পূরণ হয় না সেখানে আমরা আমাদের মানুষের কাছ থেকে কি আশা করি? আওয়ামী লীগও কিছু আশা করে না। অতীতের ক্ষত থেকে তারা শিক্ষা নিতে চায়। ধর্মকে সবাই যখন পুঁজি করে, তখন আওয়ামী লীগের কি দোষ? কারণ জনগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক নয়, জনগণ শুধু নতুন প্রজন্মের নতুন ভোট নয় যার জ়োরে সে ক্ষমতায় এসেছে, জনগণ বলতে আরো কিছু বোঝায়। এই জনগণকে আওয়ামী লীগও ঠিক মতন চেনে না।

তবে এই জনগণও আওয়ামী লীগকে ভালোবাসে, যেমন ভালোবাসে তার দেশ তার ধর্মকে, সমাজকে, সংস্কৃতিকে। হাজার বাড়ি-ঘর ধ্বসে পড়লেও- পুড়ে মরলেও-সাইক্লোনে ভেসে গেলেও, রিলিফ না পেলেও-চালের দাম বাড়লেও-সন্ত্রাস-পুলিশের শত অত্যাচারেও এই জনগণ টিকে থাকে, তার ধর্মীয় অনুভূতিও টিকে থাকে। আর এমনই অশিক্ষা আর দুর্ভোগের করাত জনতার উপর দিয়ে যায়, এই জনগণ চাইলেও ঐ আফিমের নেশা থেকে বের হতে পারে না। ফলে আফিম ব্যবসায়ী সহজেই জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আওয়ামী লীগও এখন আফিম ব্যবসায় নামতে চায়, এবং প্রয়োজনে কোকেন, গাঁজা, হেরোইন সরবরাহেও তার আপত্তি নাই।

এবার আসা যাক প্রথম প্রসংগটিতে, যুদ্ধাপরাধের বিচার। বাস্তবতা বলে আওয়ামী লীগ একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল, যারা আমাদের এ বিষয়ে সহায়তা করলেও করতে পারে। অন্যদের সে সুযোগও নেই। কারণ আওয়ামী বিরোধীতার সাথে সাথে তারা স্বাধীনতা বিরোধী উত্তরীয়টিও স্বেচ্ছায় পড়ে নিয়েছেন। এরা বেশিরভাগ একাত্তরের ঘাতক ও তাদের সহমর্মী। এদের বিচার আমরা চাই, বিশেষত নতুন ভোটাররা এবং যারা অনেক আগেই বুঝেছেন বিএনপি তে ভরসা নেই, তারা এবার আশা করে নৌকাকে গতিশীল করেছেন। আমাদের প্রত্যাশা কি? সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করবে। আর আওয়ামী লীগের? এই আবেগ নিয়ে বাণিজ্য? তা করতেই পারে। ৭৫ এর পরের কোন সরকার যেখানে কিছুই করেনি, সেখানে আওয়ামী লীগ এই কাজটা করার সুফলটুকু ভোগ করতেই পারে। পারলে এটাকে একটা hanging ইস্যু বানিয়ে যদি সেটাকে এর পরের নির্বাচনের জন্য শিকেয় তুলে রাখে তাতেও ক্ষতি নেই। ৪০ বছরে যা হয়নি তা ১০ বছরে হোক। আর তাতে আওয়ামী লীগেরও মহালাভ। তাহলে আওয়ামী লীগ আশা করি এ ব্যাপারে ছেলে খেলা শুরু করেনি, ভেবে চিন্তেই নেমেছে। হয় সুষ্ঠুভাবেই এই আমলে অথবা কোনক্রমে আরেকবারের জন্য ক্ষমতায় এসে কাজটি সমাধা করা যায়। বাপের হত্যার বিচার যেহেতু দুই মেয়াদের ব্যাপার, যুদ্ধাপরাধের বিচার তো আর চাট্টিখানি কথা না। যাক তবে দ্রুত শুরু করা যাক। এখনই সময়।

এখানেই বিপত্তি। কারণ আওয়ামী লীগ একই সাথে এই দুই বাণিজ্য করে নি কখনো। এখানেই ধরা খাবার ভয়। জনগণের, আওয়ামী লীগের হেরে যাবার ভয়। আর এই দুটি বিষয়কে আওয়ামী লীগই একসাথে টেনে এনেছে। নিজামী গং এর বিরুদ্ধে “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা”র অভিযোগ এনে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে। এর পর অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। জনগণ অবশ্যই এই প্রাথমিক উদ্যোগে খুশি। অন্তত স্বাধীনতাবিরোধী ও হত্যা-ধর্ষণ ও লুটে প্রত্যক্ষ মদদ দেয়া ও অংশ নেয়া কুচক্রিগুলিকে এই অপরাধে জেলে ভরা গেলো, প্রথম তালি আওয়ামী লীগেরও কিছুটা প্রাপ্য। সবগুলির বিচারের ব্যবস্থা করা যায় ধীরে ধীরে। কিন্তু প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় কেন? ট্রাইবুনাল হোক। আন্তর্জাতিক আদালত বসুক। নিদেন পক্ষে জাতীয় পর্যায়ে সরকার অনুমোদিত একটা কমিট। যার কাজ হতে পারে যুদ্ধাপরাধীদের ও যুদ্ধাপরাধের সর্বজন স্বীকৃত তালিকা প্রস্তুত করা, যে তালিকাটি দলমতসহ সকলেই মেনে নিবে, সে লিস্টে শেখ হাসিনার আপন বেয়াই থাকুক আর খালেদা জিয়ার দূর সম্পর্কের আত্মীয়েরা থাকুক। প্রচুর আর্কাইভ, ফুটেজ, রেকর্ডিং, পত্রিকার কাটিং, সাক্ষীসাবুদ যোগাড় করা আছে, বড় বড় গবেষক, আইনজীবীরা ট্রাইবুনাল কিভাবে গঠন করা যায় এ নিয়েও অনেক কথা বলে ফেলেছেন, এবং বলছেন। আওয়ামী লীগ সেদিকে না গিয়ে এই উলটো পথে গেলো কেন? এর উত্তর আমার কাছ থেকে আশা করার কোন কারণ নেই। আমি শুধু সন্দেহ করতে পারি। নেতিবাচকতার ছায়া খুঁজতে পারি, কারণ আমি জনগণের মধ্যে, আমি হারতে চাই না।

মোটামোটিভাবে বড় রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে জামায়াতে ইসলামী আমার মতে একমাত্র দল যাদের মধ্যে সত্যিকারের সাংগঠনিক ক্ষমতা আছে, গণতন্ত্রের ছিটাফোটা, অন্তত যোগ্য লোককে দলের নেতৃত্বে যেতে দেয়ার ইতিহাস শুধু তাদেরই। অন্যদের আছে পরিবারতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সুবিধাতন্ত্র। কর্মীবাহিনী সবচেয়ে অনুগত ও বিশ্বস্ত ও এদেরই। এমনকি এরাই একমাত্র দল যারা ধর্ম-রাজনীতি-অর্থনীতি এগুলির মধ্যে একটা যোগসূত্র ধরিয়ে দেয় দলের কর্মীদেরকে, হোক তা গোঁড়া/গোঁজামিল। বামদলগুলিও এ জায়গায় ব্যর্থ। বামদলগুলিও অদ্ভুত, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়েও তাদের খুব উচ্চবাচ্য দেখি না। তাদেরকে এখনো জনগণ চেনে না। কারণ জনগণ আফিমে আসক্ত এখনো। এই বিশাল কর্মীবাহিনী, যা ছাত্রদল-লীগ বা যুবদল-লীগের মতন সংখ্যায় অতি অধিক না হলেও হ্রাস পায় নি। এর কারণও সেই আফিম। যে পদ্ধতিতে শিবিরে নতুন সদস্য নিয়োগ করা হয়ে থাকে, তার দিকে তাকালেই হয়। আওয়ামী লীগ কি এগুলি জানে না? জানে, জানে বলেই আফিমের ব্যবসা সেও করতে চায়, ওলামা লীগ, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ফিরে আসি আবার জামায়াত ও শিবিরের কথায়। এই দলটি খুব ভালোভাবেই জানে ধর্ম তাদের দুর্বলতা নয়, বরং শক্তি, যা কিছু দুর্বলতা তার মূলে বাংলাদেশের অভ্যূত্থানের সময় করা পাপে। এ ব্যাপারে কিন্তু জামায়াত আওয়ামী লীগের চেয়েও সচেতন। তাদের নেতারাও এটা জানে। নিজামী দু এক বার শেখ মুজিব কে তোফায়েল আহমেদের দেয়া নামে সম্বোধনও করে ফেলেছেন এর মধ্যে। কোনভাবে যদি পাপমোচন করা যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে! লারে লাপ্পা! এর একটা উপায় জামায়াত ও শিবির নিজেই জানে, তা হলো এই সিনিয়র পাপীষ্ঠ নেতাগুলিকে দল থেকে বের করে দেয়া। তাহলেই জামায়াত শুদ্ধিলাভ করে, মাফ চেয়ে যা হবে না তাএ ঢের বেশি হবে এটা করতে পারলে। জামায়াত সে চেষ্টাও করে, মানে তার কর্মীদের একাংশের এই ইচ্ছা বলেই জানি। সেটা নিয়ে বহুবার শিবিরের সাথে জামায়াতের ঝামেলাও হয়েছে। কিন্তু জনগণ কি পাবে যদি এই কম্মটি সমাধা হয়ে যায়? আওয়ামী লীগও এই ব্যাপারটি জানে। আর এখানেই সে ভীত। তাই সে এমনভাবে ব্যাপারটিকে মোকাবেলা করতে চায়, যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। করুক, জনগণের একাংশের তাতে আপত্তি নেই।

সবে শুরু। জামায়াতের বক্তব্য, “এক মাঘে শীত যায় না”। বি এন পি কি বলে তাতে অবশ্য কিছুই আসে যায় না, কারণ কিছু বলে সে নিজেই নিজের ক্ষতি করে। জামায়াতের আসলে ক্ষতি নেই। যদি কিছু থাকে তা হলো লাভ। জামায়াত তার কর্মীবাহিনী নিজামীর ফাঁসি/ সাঈদী পুলিশে ডান্ডা খেয়ে মরে গেলেও হারাবে না। বরং এগুলি এভাবে মরে গেলে, বা কিছু হলে জামায়াতের দুই তরফা লাভ। এক বিরোধী দল হিসেবে জামায়াত অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সুযোগ পাবে, দুই যুদ্ধাপরাধী ইস্যু থেকে মুক্তি। সব ভাবেই জামায়াতের লাভ।
তাহলে জনগণের সামনে একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। কারণ জনগণ এখনো ধর্ম আর স্বাধীনতা এই বিষয়গুলিকে আলাদা করতে শেখেনি, একটু এদিক ওদিক হলেই ভজঘট। তাহলে জনগণ কি করবে? যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইবে না? তাতেও জামায়াতের লাভ। জামায়াত বেড়েই চলবে। এই রাজাকারগুলি ক্ষমতায় আবারও বসতে পারবে। উপায় নিশ্চই আছে। লক্ষ্য ও কর্মপদ্ধতি বদলাও। কার্যসিদ্ধ হবে।

এ খানে আমি একটা ভুল করে থাকতে পারি। জনগণ যদি জামায়াতের ধ্বংস না যায় তাহলে তা করা সম্ভবই না। সে আওয়ামী লীগ যাই করুক না কেন! আমি হয়ত জামায়াতের ধ্বংস চাই। তবে আমি জনগণের অংশ, সমগ্র জনগণ আমার সমষ্টি, তাতে প্রচুর বৈপরীত্যও আছে, সুস্থিরও না, যাই হোক সংশয়ে ফেলে লাভ নেই। তবে লাঠি না ভাঙ্গা সাপ না মরার কাজটি আওয়ামী লীগই করুক।