*******************
প্রত্যেকটি মহৎ কর্ম ও প্রত্যেকটি মহৎ চিন্তার শুরুটা বিস্ময়কর। প্রায়ই দেখা যায় মহৎ কর্মগুলির জন্ম রাস্তার কোনায় অথবা রেস্টুরেন্টের দরজার আবর্তে। এবসার্ডের ক্ষেত্রেও তাই। এবসার্ড জগত তার শোচনীয় জন্ম মুহুর্ত হতে আর সব বাদ দিয়ে যা অর্জন করে তা হলো মহত্ত্ব। যদি কাউকে কখনো জিজ্ঞেস করা যায় ঐ মুহুর্তে সে কি ভাবছিল, আর উত্তর যদি হয়, “কিছুই না”, ধরে নেয়া যায় এটা এক ধরণের ছল/ভন্ডামি/কপটতা। যারা এটা করতে ভালোবাসে, তাদের ভালোভাবেই জানার কথা। কিন্তু উত্তর যদি সৎ হয় তবে বুঝতে হবে সেটা হল সত্তার সেই বিপর্যস্ত অবস্থা যেখানে শুণ্যতা সক্রিয় হয়ে উঠেছে, প্রাত্যহিক অভ্যাসজাত/সহজাত প্রতিবর্তের শেকল ভেঙ্গে পরেছে, আর তা জোড়া দেবার জন্য সে বৃথাই হাতড়াচ্ছে। এগুলি হলো এবসার্ডের প্রাথমিক লক্ষণ।
পতনের মঞ্চ প্রস্তুত থাকে। ঘুম থেকে উঠা, রাস্তায় গাড়ি, অফিসে বা কারখানায় চার ঘন্টা কাজ করা, দুপুরে খাবার, আবার রাস্তা-গাড়ি, চার ঘন্টা কাজ, খাবার , ঘুম, আবার সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র আর শনিবার, ঠিক একই ছন্দে- এভাবে বেশিরভাগ সময় সহজেই পার হয়ে যায়। কিন্তু একদিন সেই “কেন” জেগে উঠে এবং বিস্ময়ের প্রলেপ মেশানো এক ধরনের ক্লান্তির আরম্ভ হয়। এই “আরম্ভ” টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।যান্ত্রিক জীবনের কর্মকান্ডের শেষে এই ক্লান্তির শুরু, কিন্তু এর অভিষেক সচেতনতার প্রণোদনায়। এটাই সচেতনতাকে জাগিয়ে তোলে এবং এর পর থেকে যা কিছু ঘটবে তার সুত্রপাত ঘটায়। এর পর যা ঘটতে পারে তা হলো হয় সেই চেনা শেকলে প্রত্যাবর্তন অথবা নিশ্চিতভাবেই জাগরণ। আর এই জেগে ওঠার ফলাফল হিসেবে পাওয়া যেতে পারেঃ আত্মহত্যা অথবা আরোগ্য। এই ক্লান্তির মধ্যে পীড়াদায়ক একটা ব্যাপারও আছে। এখানে আমি অবশ্যই বলবো এটা ভালো। কারণ এর শুরুটা সচেতনতায়। আর এর মধ্যে দিয়ে না গেলে অর্থপূর্ণ কোন কিছুই পাওয়া যাবে না। এই কথাগুলির মধ্যে মৌলিক কোনো ব্যাপার নেই। তবে এগুলি অবশ্যম্ভাবী। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এবসার্ডের উৎপত্তির বিচারে এগুলিকে যথেষ্ট ধরে নেয়া যায়। হাইডেগারের মতে নিছক “উদ্বেগ”ই সবকিছুর মূলে।
প্রাত্যহিক ব্যাঞ্জনাহীন দিনগুলিতে সময়ই আমাদের জীবনকে বয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু এমন একটা সময় আসে যখন আমাদেরকেই তা বয়ে নিয়ে যেতে হয়। আমরা ভবিষ্যতের উপর বেঁচে থাকি। “আগামীকাল”, “পরে”, “যখন তুমি নিজের মতন করে পারবে”, “তুমি বুঝবে যখন তোমার যথেষ্ট বয়স হবে”। এই অসংগতিগুলি চমৎকার, কারণ এর সাথে মৃত্যু জড়িত। এর পর একদিন আসে যখন মানুষ বুঝতে পারে বা বলে ওঠে তার ত্রিশ পার হয়ে গেছে। যৌবনের ঘোষণা এটা। একই সাথে সে নিজেকে সময়ের সাথে সম্পর্কিত করে। মহাকালের পথে তার নিজের জায়গা করে নেয়। সে দাবি করে সে কালরেখার নির্দিষ্ট এক বিন্দুতে এসে পৌছেছে এবং এর শেষ অবধি চলতে থাকার প্রবণতা টের পায়। সময়ের দাস হিসেবে নিজেকে খুঁজে পায়। ভয়ে অবরুদ্ধ হয়ে সে তার সবচেয়ে বড় শত্রুকে চিনতে পারে। অনাগত কাল, সে অনাগত কালের পথে চলছিল। যেন তার সর্বস্ব এটিকে অস্বীকার করতে চাইতে থাকে। এই রক্ত মাংসের বিদ্রোহই হল এবসার্ড।
এর পরের ধাপে এক ধরনের অপরিচিতের অনুভূতি নিঃশব্দে এগিয়ে আসেঃ পৃথিবীকে মনে হয় “মূঢ়(dense)”, একটা পাথরের টুকরো কেও বিষম মাত্রায় অজানা এবং অমোচনীয়/অনমনীয় মনে হয়, প্রকৃতি আর তার দিকচক্রবালরেখা পর্যন্ত প্রচন্ডভাবে আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিভাত হয়। প্রত্যেকটা সৌন্দর্যের কেন্দ্রে থাকে এক ধরণের অমানবিক ব্যাপার। এই পাহাড়, আকাশের কোমলতা, বৃক্ষরাজির অবয়ব, সবকিছু ঐ মুহুর্তটিতে দৃশ্যায়িত সকল অর্থ হারাতে থাকে যা এতদিন আমরা এর উপর চাপিয়ে রেখে ছিলাম; যেন হারানো বেহেশত থেকে ছুটে এসেছি। এত সহস্রাব্দের পরে পৃথিবীর আদিম বৈরীতা জেগে ওঠে আমাদের সামনে। এক মুহুর্তের জন্য একে অনুধাবন করতে ব্যার্থ হই আমরা। তার কারণ বিগত শতাব্দীগুলি জুড়ে আমরা কেবল আগে থেকে শিখিয়ে দেয়া কতগুলি চিত্রকল্প ছাড়া অন্য কিছুই বুঝতে শিখিনি। আমরা এখানে সেই একই কৌশল কাজে লাগাতে ব্যর্থ হই। নিজের আকার ধারণ করে এই জগত আমাদেরকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়। চিরাচরিত অভ্যাসে মঞ্চায়িত দৃশ্যের অবতারণা ঘটে, কিন্তু এবার তার স্বরূপে। আমাদের থেকে কিছুটা দূরত্বে নিজেকে স্থাপণ করে। ঠিক যেমন কোন কোন দিন, যখন আমাদের অতি পরিচিত ভালোবাসার নারী, যাকে আমরা মাস বা বছর আগেও ভালোবেসেছি তাকে অচেনা মনে হয়, বরং এমন এক আকাঙ্ক্ষার দিকে ধাবিত হই যা আমাদের একা ফেলে রেখে যায়। কিন্তু আসল সময় এখনো আসেনি। শুধু একটা ব্যাপার ঘটেছে ঐ মূঢ়তা আর জগতের অপরিচিত চেহারার মাঝেঃ এবসার্ড।
মানুষ নিজেও অমানবিকতা তৈরী করে। কোন কোন সচ্ছন্দ মুহুর্তে, অঙ্গভঙ্গির যান্ত্রিকতা, অর্থহীন মূকাভিনয় আশে পাশের সবকিছুকে বোকা বানিয়ে ফেলতে পারে। কোন ব্যাক্তি কাঁচের বিভেদের আরেকপাশে টেলিফোনে কথা বলছে, আপনি তাকে শুনতে পাচ্ছেন না, কিন্তু তার নির্বাক কর্মকান্ড আপনি দেখছেন, আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, সে লোকটা কেন বেঁচে আছে? মানূষের অমানবিক অনুভূতির মধ্যে এই যে অস্বস্তি, দৃশ্যমান সবকিছু থেকে এই যে স্খলণ, আজকের লেখকেরা যাকে বলছেন ‘বিবমিষা’(nausea), এটা হলো এবসার্ড। ঠিক সেই আগন্তুকের মতো, যার সাথে আমাদের দেখা হতে থাকে আয়নায়, সেই পরিচিত অথচ ভয়জাগানিয়া সহোদর যাকে পাওয়া যেতে থাকে নিজেরই ফটোগ্রাফে, এ হলো এবসার্ড।
শেষ পর্যন্ত আমরা উপস্থিত হই মৃত্যু এবং তার প্রতি আমাদের প্রতিন্যাসে। এ বিষয়ে প্রায় সবকিছুই বলা হয়েছে এবং কোন প্রকার করুন রসের(pathos) উদ্রেক এড়িয়ে যাওয়াই ঠিক হবে। অবাক না হয়ে উপায় নেই এ কারণে যে প্রায় সবাই এমন ভাবে চলছে, যেন কেউ কিছু “জানে” না। কিন্তু সত্যি বলতে কি কোন বিষয়ের মধ্যে দিয়ে নিজে যাবার ফলে যে সচেতনতা তৈরী হয়, শুধু তাকেই আমরা অভিজ্ঞতা বলি। সে ক্ষেত্রে অন্যের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নিয়ে বলার কিছু নেই। এটা একটা প্রতিকল্প (substitute), একটা অধ্যাস(illusion) এবং এটা কখনোই আমাদের মাঝে দৃঢ় প্রত্যয় তৈরী করতে পারে না। ঐ বিষাদের নিয়ম পুরোপুরি মানা হয়ে ওঠে না। গাণিতিক সম্ভাবনার জায়গায় বরংচ বাস্তব ভীতিকর ব্যাপার ঘটে। সময় আমাদের ভীত করে, প্রতিবারেই সমস্যা আগে উদ্ভূত হয়, সমাধান আসে পরে। অবিনশ্বর আত্মা সম্পর্কিত সকল মিষ্ট বাক্যের বিপ্রতীপ উপপাদ্য খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্তত একবারের জন্য হলেও সত্য মনে হয়। এই নির্জীব দেহ থেকে একটা চড়ের আঘাত ও যার লাগে না, সেই আত্মা উধাও হয়। এই নির্দিষ্ট প্রাথমিক অভিজ্ঞতার বিষয়গুলি মিলে হলো এবসার্ড অনুভূতি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এর অনোপযোগিতা সুস্পষ্ট প্রতিভাত। যে নির্মম গণিতের উপর আমাদের অবস্থা নির্ভর করে তার পূর্বশর্ত হিসেবে কোন নৈয়ায়িক সুত্র বা চেষ্টাই টেকে না।
আমি আবারও বলছিঃ এ কথাগুলি অনেক বার বলা হয়েছে। আমি শুধু এগুলিকে দ্রুত চিহ্নিত করে এর অবশ্যম্ভাবী মূলসুরটুকু চিনিয়ে দেয়ার মধ্যে নিজকে সীমিত রাখবো। প্রত্যেক দর্শন, প্রত্যেক সাহিত্যে এগুলিকে খুঁজে পাওয়া যাবে। দৈনন্দিন কথাবার্তায়ও এগুলি। নতুন করে আবিষ্কারের কিছু নেই। কিন্তু এই মৌলিক বিষয়ে নিজেকে প্রশ্ন করার আগে ঘটনাগুলি সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে নেয়া প্রয়োজন। আমি ইচ্ছে করেই পুনরুক্তি করছিঃ এবসার্ড আবিষ্কারে বা তার ফলাফলে খুব গভীরে যাবার দরকার নেই। যদি একজন ব্যাপারগুলিতে নিশ্চিত হয়, তাহলে সে কি সিদ্ধান্ত নেবে? কতদূর পর্যন্ত সুকৌশলে এড়িয়ে চলতে পারবে? আত্মহত্যা করবে, নাকি এ সব সত্ত্বেও আশা করবে? তার আগে বুদ্ধিমত্তার সমতলে কিছু দ্রুত সঞ্চয়ন প্রয়োজন।
*******************
(চলবে)