Friday, June 18, 2010

সিসিফাস পুরাণ

সিসিফাস। গ্রীক পুরাণের সিসিফাস। হোমারের সিসিফাস। কে এই সিসিফাস? কেন তাকে নিয়ে আগ্রহ খুঁজে পাই এবসার্ডিস্ট কামুর মধ্যে। “Absurd” এর বাংলা কি হবে? বাংলায় কি আদৌ এই উপলব্ধি সম্ভব? কামুর মতে বিশ্বমানবের চেতনার শুরুই কিন্তু এক ধরণের এবসার্ড থেকে। তাহলে বাঙালি কোনোভাবেই বাদ যায় না। অনেকে এর বাংলা করেছেন, “উদ্ভট”, উদ্ভট বটে। তবে ইংরেজী Absurd এর মধ্যে যে অসংগতি আছে তা উদ্ভটে এসে তার সঠিক চরিত্র ধরে রাখতে পারে না। তাই আমরা এটাকে এবসার্ড বলেই সম্বোধন করবো যতক্ষণ না পর্যন্ত তার চরিত্র অনুযায়ী তাকে একটা দশাসই বাঙালি পোশাক না পরানো যায়।

এবসার্ডের শুরু কোথায়? অস্তিত্ববাদী মানুষ।। তাই সে তার সুখের সন্ধান করবেই।। কামুর মতে সুখের সন্ধান করতে গিয়েই একজন এবসার্ডকে খুঁজে পাবে। উল্টো ব্যাপারটাও ঘটতে পারে। বিষ্ণুপুরাণে অভিশপ্ত জয়-বিজয়, মনসামঙ্গলে চাঁদ সওদাগর, হোমারে অভিশপ্ত সিসিফাস, সফেক্লিসে ইদিপাস। কখনো কখনো মনে হতে পারে ঈশ্বরের আইন, দেবতার নিয়ম মানেই কি এবসার্ড? তবে নিশ্চিত ভাবেই এবসার্ডে আক্রান্ত মানুষ তার পৃথিবী থেকে ঈশ্বরকে বিতাড়িত করতে চায়, দেবতাকে শৃঙ্খলে বাধঁতে চায়।

সিসিফাস রাজা, অথবা সিসিফাস দস্যু। তাতে কিছু আসে যায় না। অসংগতি এখানে নয়। অসংগতি দেবতাদের রোষে। জুপিটার হরণ করে এসোপাসের কন্যা এজিনাকে। সাক্ষী সিসিফাস। এসোপাসকে সে বলে দেয় সবকিছু, বিনিময়ে করিন্থের জন্য জলের সরবরাহ নিশ্চিত করে। কথিত আছে সিসিফাস দেবতাদের রহস্য জেনে যায়। সে মৃত্যুকে বেঁধে রাখে। ফলে অনেকদিন যাবত কেউ মারা যাচ্ছিল না। এরেস যুদ্ধে কোন ফলাফল না দেখে রুষ্ট হয়। হেডস রুষ্ট তার পাতালপুরীর নির্জনতায়। মৃত্যুকে শৃঙ্খলমুক্ত করে সিসিফাসের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। কি সেই শাস্তি?

সিসিফাস মৃত্যু আসন্ন জেনে তার স্ত্রীকে বলে রাখে যাতে তার শবদেহটা মৃত্যুর পর নগর চত্বরে ফেলে রাখা হয়। পাতালপুরীতে জেগে ওঠে সিসিফাস। দেবতাদের কে সে জানায় সে তার স্ত্রীর উপর ক্ষুব্ধ। কারণ তার সৎকার করা হয় নি। সে পৃথিবীতে ফেরত গিয়ে স্ত্রীকে তিরস্কারের ছল করে। অনুমতি মিলে যায়। আবার পৃথিবীর মুখ দেখে সিসিফাস। সে ভুলে যায় তার শাস্তির কথা, ভুলে যায় মরণশীলতা, ক্ষণিকের জন্য সে আবার সংসারের আনন্দ উপভোগ করতে শুরু করে। দেবতার রোষ- ক্রোধ সব ভুলে যায় সে, সত্য-মিথ্যা-ন্যায়-নীতি-ভাগ্য এ সবের ঊর্ধ্বে স্থান পায় প্রিয় পৃথিবীর জন্য ভালোবাসা। ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তাকে টেনে আবার পাতালে নিয়ে যায় হারমেস। যেখানে তার জন্য প্রস্তুত তার শাস্তি-একটা বিশালকায় পাথর। এটা কি এবসার্ড? নাকি দেবতার রোষাগ্নি? অথবা পৃথিবীর প্রতি মানুষের প্রেম? সত্য কোনটা?

সিসিফাসের জন্য দেবতারা এর চেয়ে নিষ্ঠুর শাস্তি আর কি দিতে পারতেন! সিসিফাসকে এই পাথরটা গরিয়ে তুলতে হবে পর্বতের চূড়া পর্যন্ত, যেখান থেকে সেটা আপনা হতেই আবার গড়িয়ে পড়বে। এই নিস্ফল পরিশ্রম হলো সিসিফাসের শাস্তি। কোন প্রাপ্তি নেই। যতবার পাথরটাকে তুলে নিয়ে যাবে উপরে, ততবার তাকে হতাশ করে দিয়ে পাথরটা আপনা থেকেই গড়িয়ে পড়বে নিচে। তাকেও ফিরে যেতে হবে পাথরের পিছু পিছু।

কামুর আগ্রহ ঠিক ওখানেই, যেখান থেকে সিসিফাস ফিরে আসে। ঐ সামান্য থামা। যেখানে থেকে সে দেখতে পায় পাথরটা নেমে যাচ্ছে। এর পর সে আবার ফিরে যায় পাদদেশে। কামুর মতে এখানে কোথাও থামতে হয় মানুষকে। কামুর কথা হলো, ওখানেই ট্রাজেডি, কারণ আমাদের নায়ক সিসিফাস সচেতন। কামু যে তিনটা বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করতে চেয়েছেন, তা হলো “আশা”, “এবসার্ড” আর “মৃত্যু”। আজকের মানুষও কাজ করে যাচ্ছে। আজকের মানুষের পরিণতিও তাই এবসার্ড। তবে ট্র্যাজেডির শুরু যখনই সে এই এবসার্ড সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠছে। চাঁদ সওদাগর জানতো তার বাণিজ্যতরী বার বার নিমজ্জিত হবে, লক্ষীন্দরকে সাপে কাটবে, তবু সে আশা করে। ইদিপাস না জেনে তার ভাগ্যকে অনুসরণ করে, ঠিক যে মুহুর্তে জেনে যায় সে মুহুর্ত থেকে শুরু হয় ট্র্যাজেডি। সে ঘোষণা করে এবসার্ডের জয়। দেবতার প্রলেতারিয়েত সিসিফাস বিদ্রোহী কিন্তু তার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। তাই বরাবরের মতন তাকে ফিরে যেতে হয় পাথরের কাছেই।

তবে এর মধ্যে কি আনন্দ কোথাও নেই? পৃথিবীর সুখস্মৃতি সিসিফাসের মনে চির জাগরুক। এই যে পাথরের সাথে সাথে সিসিফাস আবার নতুন করে শুরু করে, এটা যে সবসময় দুঃখের-হতাশার তা নয়, কামুর মতে এটা কখনো নতুন আশার-আনন্দের। ইদিপাস তার সমগ্র জ্ঞান, সমগ্র সত্বা দিয়ে ঘোষণা করে, “All is Well”। সিসিফাসও ফিরে যায় পাথরের কাছে, লক্ষীন্দরের জন্য সাজানো হয় বাসর।

কামুর মতে সিসিফাসের আনন্দ তার নিজের কাছেই, এক ধরনের নিরব আনন্দ। তার ভাগ্য তার নিজের হাতেই। পাথরটাই তার চেতনা। সব আদর্শকে ম্লান করে দেয় এই বোধ। এখানেই জয়ী একজন এবসার্ড মানুষ। সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তকে বাতিল করে এবং ভাগ্যকে সচেতনভাবে নিয়ে যায় এই অবিরাম চেষ্টার মধ্যে দিয়ে। বিষয়ীগত এই জায়গাটিতে এসে সে নিজের চেয়ে বড় আর কোন বিধিকেই খুঁজ়ে পায় না। সেখানে সে ফিরে এক পলক দেখে তার জীবনের দিকে, এবং তার এই পরিণতির রূপকার হিসেবে নিজেকেই পায়, সিসিফাস প্রত্যেক বার ফিরে যায় পাথরের দিকে, এবং পিছনের প্রতিবারের সিদ্ধান্তের জন্য নিজেকেই পায়। অন্ধ মানুষ জানে যে রাত্রির শেষ নেই, কিন্তু তাকে চলতেই হবে। সেও ঘোষণা করে, “All is Well”। পাথরটা গড়াতেই থাকে। সনাতন পুরাণের জ্ঞান ঘোষণা করে আধুনিক মানুষের বীরত্বগাঁথা।

(চলবে)