Saturday, February 28, 2009

বি ডি আর বিদ্রোহ, সেনাবাহিনীর জন্য শোক, সরকারের জন্য সতর্কতা, মিডিয়ার জন্য হুঁশিয়ারি এবং ...

২৫ শে ফেব্রুয়ারি এমন একটি ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছিল এবং আজ তিন দিন পর তা যে জায়গায় এসে দাড়িয়েছে, তাতে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ স্তম্ভিততিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষনা করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য সরকার ও সেনাবাহিনী কাজে নেমে পড়েছেখুব সংক্ষেপে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ঘটনাবলীর সার হলোঃ
-
বি ডি আর সদর দপ্তর পিলখানায় বি ডি আর জওয়ানদের সশস্ত্র বিদ্রোহে উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারসহ আনুমানিক দেড় শতাধিক ব্যক্তি নিহত


ঘটনা নির্মম কোনো সন্দেহ নেইযে কোন হত্যাকান্ডই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য আতঙ্কেরপঁচা-গলা-দগ্ধ লাশগুলি যেভাবে উদ্ধার হচ্ছে গণকবরগুলি আর ড্রেনগুলি থেকে, সেই দৃশ্য দুর্বল/সবল হৃদয়ের মানুষের জন্য বিব্রতকরপ্রথমদিন তিনজন বেসামরিক মানুষের নিহত হবার খবর যখন এসেছিল, খেয়াল করলে দেখা যায় তখন মিডিয়ায় বা জনসাধারণের মধ্যে শোকের মাতম শুরু হয়নি, যা এখন আমরা দেখছিপ্রকৃত মৃতের সংখ্যা এবং লাশগুলির অবস্থা সচক্ষে দেখার পর আর সে অবস্থা নেইসেই তিনজন নিহতের মধ্যে ছিল একজন রিক্সাচালক, একজন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও আরেকটি কিশোর সম্ভবত যার বয়স ছিল ১২


শুরুতেই যেটা আমরা টি ভি চ্যানেলগুলিতে দেখি তা হলো বি ডি আর এর এই বিদ্রোহের যথার্থ কারণ অনুসন্ধানের একটি প্রচেষ্টাখুব স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়া এ কাজ করবে, কিন্তু আবেগের আতিশয্যে কিংবা অন্য কোন কারণে মিডিয়াতে কেউ কেউ একে বিপ্লব বলে আখ্যা দিয়ে দিচ্ছিলেনযার ফলে জনসাধারণের সমর্থন চলে গিয়েছিল বি ডি আর এর পক্ষেপরে অবশ্য বিডিনিউজের সম্পাদক নিজে বলেন, “আমরা ক্ষুধার্ত থাকিতার মানে মিডিয়া তার সংবাদ ক্ষুধার জন্য এই ধরণের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত চরম সংকটময় ঘটনাটিকেও আরেকটু হলে বাংলাদেশ রাইফেলস বনাম সেনাবাহিনীযুদ্ধের শিরোনাম দিয়েই বসেছিলগুজবের কমতি ছিল না এই তিন দিনে২৬ তারিখ দুপুরের পর ট্যাঙ্কের ছবি দেখে অনেকে আশঙ্কা করছিলেন সেনা অভ্যুত্থানেরযাই হোক সরকারের কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে এটাকে অনেকে আখ্যায়িত করছেন, অন্তত আবেদ খান ও তার সমমনা অনেকেই মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন এ বিষয়ে, সেদিন সন্ধ্যার মধ্যে বি ডি আর অস্ত্রসমর্পন করে ফেলে


জাতীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত এ বিষয়গুলি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র বিভাগেরতবে সরকার এ কাজে ব্যর্থএই আখ্যা দিচ্ছেন বি ডি নিউজ সম্পাদকতার মতে, মিডিয়া যে ভুলগুলি(?) করেছে তা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারতোএর পরেই তিনি কিছু উদ্ভট যুক্তি/উদাহারণ টেনেছেনএকই সাথে মিডিয়ের উপর তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রভাব না থাকা এবং রেগুলেটরী ফর্মের কথা উল্লেখ করেছেনএটা ঠিক যে সরকার ঠিক কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করবে তার রূপরেখা সরকার নিজেই নির্ধারণে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতবে মিডিয়া নিজের দোষ স্বীকারের আগেই তথ্যমন্ত্রী টি ভি চ্যানেল মালিকদের ডেকে গতকালই একটি মিটিং করে ফেলেছেনমিটিং শেষে তার বক্তব্য, “যাতে সবার ভালো হয়...এই জাতীয়আবারো আমাদের দেশের একটি কার্যকর তথ্য অধিকার ও প্রবাহ সংক্রান্ত নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে


ঘটনার অনুসন্ধান শুরু হবার আগে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে এরকম একটি ঘটনা ঘটলো কেন? মিডিয়া আমাদের সাহায্য করেছেসেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে বি ডি আর এরযে দুয়েকটা তথ্য মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে তা হলো, বি ডি আর এর নিজস্ব জওয়ানদের পর্যাপ্ত পদোন্নতি ও সুযোগসুবিধার অভাবতার মানে এই বিষয়ে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এই বিদ্রোহকারণ আর যাই হোক ২৫ তারিখ সকালে হঠাৎ করে নিশ্চয়ই ধরণের অগ্ন্যুৎপাত ঘটেনিঅবশ্য এ ছাড়া আরো অনেক কারণ থাকতে পারেযৌক্তিক/অযৌক্তিক এই ধরণের মাপকাঠিকে যাবার আগে আমাদের এই কারণগুলির সবগুলির সন্ধান করা দরকারঅন্তত আশা করি সামনে যে তদন্ত হবে তাতে এসব ব্যাপার থাকবেতবে এই ধরণের একটি বিশাল ঘটনার অনুমান কি আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি কোনোভাবেই করতে পারে নি? আজকে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের অফিসারকে এ বিষয়ে তাদের ব্যর্থতা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “তার অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে ...নাক গলান নাতবে প্রয়োজনে যে তারা যত্র তত্র বাঁকা আঙ্গুল পর্যন্ত প্রবেশ করান তা আমরা দেখেছি গত দুই বছরের অনির্বাচিত সরকারের আমলেবি ডি আর যদি অন্য কোন প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকে তবে তাতে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ না দিলেই হয়বি ডি আর এর জন্য নিজস্ব নিয়োগ ব্যবস্থার মাধ্যমে কমিসশনড পদে সদস্য নিয়োগের দাবি তো আর আজকের নয়


আর কি কি কারণ থাকতে পারে? আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের মহল থেকে এখন একটি শব্দ উচ্চারণ করা হচ্ছে, “ষড়যন্ত্রশব্দটি এমনই যে এর সাথে কর্তা সন্ধানের ইচ্ছা শ্রোতার মনে জাগবেই। "তথাকথিত বাম" রাশেদ খান মেনন এই ষড়যন্ত্রকে, “যুদ্ধাপরাধী বিচারের ইস্যুকে পাশ কাটানোর চেষ্টা এবং এখানে না থেমে, বি ডি আর এর মধ্যে গত কিছু দিনে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটিটাকা ছড়ানোর কথা বলেনএখন কে বা কারা ছড়িয়েছে সেটা বের হয়ে আসলেই হয়তবে এ ধরণের মন্তব্য তিনি দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন আশা করিফিলিস্তিন কোন আপ্তবাক্য যেন না হয়একই প্রসঙ্গে বি ডি আর এর সাবেক মহাপরিচালক আনোয়ার হোসেন বীর প্রতীক বলেছেন, বি ডি আর এর মধ্যে পূর্বের কোন ক্ষোভছিল না একটি বেসরকারি টি ভি চ্যানেলে কথাগুলি বলার সময় তিনি বেশ নাটকীয়তা তৈরী করেনতার মতে বর্ডারে যত দূর্নীতি সব করে বি ডি আর জওয়ানেরা এবং সেনাবাহিনীর কারণে সেগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ থাকেতার মানে সেনাবাহিনী ধোঁইয়া তুলসী পাতাআবার তিনি ভবিষ্যতে বি ডি আর পুনর্গঠনের সময় যে সেনাবাহিনীরই প্রয়োজন হবে তারও উল্লেখ করেনতার মানে বি ডি আর এর ক্ষোভের যদি কোন কারণ থেকেও থাকে তবে তা ভুলে যাবার বা ভুলিয়ে দেবার একটি চেষ্টা চলছে


আর কে কে ষড়যন্ত্র করতে পারে এই সব বিষয়ে? বহিঃশক্তি? এই বহিঃশক্তির নাম যতবারই নেয়া হয় কেমন যেন এক ধরণের রহস্য তৈরী হয় সব ক্ষেত্রেইঅনেক রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি এ পর্যন্তে অনেক বিষয়েই এই বহিঃশক্তিকে টেনে এনেছেনএকটা জিনিস ভুলে গেলে চলবে না এই বহিঃশক্তি যদি থেকেও থাকে, তবে ঘরের শত্রু বিভীষণকে খুঁজে বের করা আগে প্রয়োজন, কারণ তাকে ছাড়া সমুদ্র-বন্ধন বহিঃশক্তির পক্ষে সম্ভব নয়


টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে আজ দুপুর এর পর থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে সাধারণ ক্ষমার প্রকৃত অর্থ বোঝাতে প্রধানমন্ত্রীর এক সচিবের(সম্ভবত) প্রেস ব্রিফিংখুব ভালো উদ্যোগকিন্তু আমাদের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বললেন, “যদিবি ডি আর এর নিজস্ব আইন না থাকে, তবে নতুন আইন…”তার মানে সরকারের এত বড় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাহেবের অবস্থা সাধারণ জনগন থেকে ভিন্ন কিছু নয়নয়ত এই যদিথাকতো নাএখানে অনেকেই আমার প্রতি ছিদ্রান্বেষনের অভিযোগ আনতে পারেনকিন্তু এত বড় ঘটনা যেখানে সারা দেশবাসী আতঙ্কিত, আমাদের ভবিষ্যতকে এ ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে, সেখানে আমরা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তথা আমাদের রক্ষকদের মধ্যে গা ছাড়া ভাবখানি কোনোভাবেই সইতে পারিনাসরকারের এ পর্যন্ত কার্যকলাপকে সন্তোষজনক কিংবা ব্যর্থ কোনোটাই বলার উপায় নেই, কারণ যদিও হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য এমনকি কখন হত্যাকান্ডগুলি সংঘটিত হয়েছে তার পক্ষেও যথেষ্ট প্রমানাদি হাতে নেই, তদুপরি মনে হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে এইরকম একটি সময়ে অন্তত আমরা ঘন্টায় ঘণ্টায় প্রেস ব্রিফিং আশা করতে পারতাম, অন্তত তা হলে প্রথম দিন মিডিয়ার দায়িত্বহীন আচরণে যদি আদৌ কিছু ঘটে থাকে তার একটা প্রতিকার হতোপ্রথমদিন দুপুরের আগ পর্যন্ত সরকার প্রায় কিছুই বলেনিতবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা বি ডি আর এর ভিতরে গিয়েছেন, জিম্মি উদ্ধার করেছেন এ বিষয়গুলির দরকার ছিল


এরপর আসা যাক আজকের হঠাৎ আটক অবস্থা থেকে বি ডি আর এর সদস্যদের হঠাৎ হাওয়া হয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটিতেযতদূর জানা যায় সেনাবাহিনী ঘেরাও এর মধ্যেই এ ঘটনাটি ঘটেছেআশা করি এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ সঠিক তথ্যানুসন্ধান করবে কাউকে বা কোনো গোষ্ঠিকে বাঁচিয়ে দেবার জন্য এ ঘটনাটি ঘটেনি আমরা অন্তত সেই আশাই করবো


আমাদের জন্য অবস্থাটি এতই শোচনীয় যে, একদিকে আমাদের প্রতিরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সেনাবাহিনীর এতগুলি কর্মকর্তা ও তাদের পরিজনদের আমরা হারিয়েছি, আবার সেই সাথে সীমান্ত প্রহরী বি ডি আর এর প্রতি তৈরী হয়েছে এক ধরণের অবিশ্বাসতবে প্রশ্ন অনেকগুলিসরকার ও মিডিয়ার পারস্পরিক সম্পর্ক, বি ডি আর এর পুনর্গঠন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, সঠিক কারণ অনুসন্ধান, বি ডি আর জওয়ানদের পালিয়ে যাবার উপায় সন্ধান, গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা ইত্যাদি


আর্মির প্রতি আমাদের একটা ধারণা আছেবি ডি আর এর প্রতিও কাছাকাছি ধারণা অনেকে এই সুযোগে সমগ্র বি ডি আর কে দেশের শত্রু, এমনকি হানাদার বাহিনীর সাথে তুলনা করে ফেলছেনএদেরকে Institutionalized ভেবে আমরাও প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করছিএরা সবাই আমাদের মতই দেশের মানুষতবে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার আমরা চাই