কবি-কৃতীর দেশ
কোন এক কালের কথা। নগরের নাম ইন্দ্রপ্রস্থ। সেই নগরের পাশে এক নদী। নদীর পাড়ে এক বাড়িতে বাস করেন কবি। আমাদের দেশের বর্তমানের কবি কী করে ভুলে যান। একশ দুশ বছর আগের কবি কী করেছেন তাও ভুলে যান। ভুলে যান বাল্মীকি-কালিদাস-হোমার। সে এক অন্য কালের কথা বলছি। বলছি অন্য এক যুগের কথা। এমনকি সামনের যুগের সাইবার-ওয়েফার-ভার্চুয়াল কবিদের কথাও মনে আনবেন না। তাহলে এ কবি কোন যুগের?
কোন যুগের জানিনা তবে এই কবির কথা বলতে পারি। কবির ঘর আছে। নগরের সকলেই জানে নদীর ওপাশটায় কবির বাস। নগরে যেমন কামারের ঘর, দর্জির ঘর, গোয়ালার ঘর, ধোপার ঘর তেমনি আছে কবির ঘর। এ এমনই এক যুগ। বলবেন এরকম তো আছেই। আমাদের পাড়ায়ও এক কবি আছে। সকলেই চেনে। আমাদের পাড়ায়ও বিভিন্ন পেশার লোক আছে আর কবির ঘর বললেই তো সকলে ঐ চিলেকোঠার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ঈর্ষায়, বিরক্তিতে ভ্রূ কুচকায়। না এযুগের কবি বিরক্তির নয়। এ যুগের কবি ভিন্ন। জেলে যেমন জেলে, তাঁতী যেমন তাঁতী, গোয়ালা যেমন গোয়ালা এ যুগের কবি তেমনি কবি। তাই তার আছে ভিন্ন পরিচয়।
ভাবছেন এ আবার কী কথা? জেলে তাঁতীর মতো কবি? হ্যাঁ ঠিক তাই। এ যুগটাই এমন; কবিরাও যেমন। এই কবি না সিনেমার নায়ক, না বিজ্ঞাপনের মডেল, না বড় কোম্পানীর চাকুরে।
ভাবছেন এওবা কেমন কি। আমাদের আকবর রাজাতো তার সভায় কবি পুষতেন। আমাদের কত বাদশাহ সুলতানের আমলে তাদের দরবারে কবিরা থাকত। কবিদের জন্য ভাতা ছিল, রাজদন্ড ছিলো, কবি-অর্ঘ্য, কত কি!
না আপনাদের ঐসব যুগের কবিদের মতন নয়। যুগটাই অন্য, কবিরাও ভিন্ন। ভাবছেন পেশাদার কবিদের কথা বলছি। ভাববারই কথা। আপনাদের আছে পেশাদার শিল্পী, পেশাদার বৈজ্ঞানিক, পেশাদার শিক্ষক আরো কত কি। পেশাদার বাবা-মা বানানোর আগেই আপনারা পেশাদার কবি বানাবেন, এটা আপনাদের দ্বারাই সম্ভব।
পেশাদার মানুষ যেমন সম্ভব না, তেমনি সম্ভব না পেশাদার কবি।
যে যুগের কথা বলছি, সে যুগে-
কবি সমাজেই আছেন। সমাজের মানুষের মাঝে। ছেলে বুড়ো থেকে সৈন্য-সিপাহী, ঝাড়ুদার- মুর্দাফরাস, এসকর্ট মাদকাসক্ত, সকলের সাথে কবির বসবাস। সবাই কবির কাছে আসেন। জীবনে একবার নয়, বছরে নয় কবি তাদের প্রায় নিত্য প্রয়োজনীয়- যেমন কৃষক-কামার-কুমার। এই আশ্চর্য অনুভুতিময় মানুষেরা নিজেরাই কবির কাছে আসেন। যেমন আমরা যাই, ক্যারিয়ার কনসালটেন্সীর জন্য, উকিল-ডাক্তারের কাছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেদিন ওপাড়ার ছেলেটা পঁচা শামুকে পা কেটেছে। সবাই দৌড়ে নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সেলাই ব্যান্ডেজ করে দিলেন। এরকমই এ নগরের, এই যুগের মানুষেরা দৌড়ে যান কবির কাছে।
আপনারা বলবেন, না আমরা কবির কাছে যাবো না। অন্তত দৌড়ে যাবার তো কথাই আসে না। আমাদের ঘরে যেমন আমরা আয়োডিন, কাঁচি , গজ রাখলে শামুক কাঁটা পা নিয়ে ডাক্তার লাগে না, তেমনি যাবো না কবির কাছে।
আমি বলি কি আমার কথাটা মেনেই নিন। আপনাদের যুগের কথা বলছি না। এ যুগের মানুষ বড় আশ্চর্য অনুভূতির, বড় অদ্ভুত সে দেশ, কবি-কৃতীর দেশ। আপনাদের চেয়ে ঢের বেশি প্রখর তাদের সংবেদন। আপনাদের বড় জোড় রোদ-ঝড়-বৃষ্টি অথবা সুর্যোদয়-সুর্যাস্তে কবিকে প্রয়োজন হয়। বাহুলগ্না প্রেমিকা- একুশে ফেব্রুয়ারি- বৈশাখীমেলা আপনাদের কবিতা যোগানোর দিন। এ যুগ এমনটা নয়।
এ যুগের মানুষের অবিরাম অজস্র অনাবিল অনুভুতি- আর কবিরও অদ্ভুত কাজ। সবগুলি অনুভুতি-সংবেদনের নাম দিতে হয়। তারা আসে। কবি তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। শুনে বোঝার চেষ্টা করেন ঠিক কোন অনুভুতির নাম জানতে তারা এসেছেন। কবির ভান্ডারও অফুরন্ত। একটা না একটা নাম মিলেই যায়। মানুষগুলো সেই নামগুলি শিখে খুশি মনে বাড়ি যায়। অপূর্ব সন্তুষ্টিতে। কবি কাঊকে কোনদিন ফিরিয়ে দেন নি।
আপনাদের তো শত অভিযোগ; বিশেষত কবির বিরুদ্ধে। ঠিক যেমন আপনারা মাছ বাজারে পঁচা মাছ পেলে জেলেকে শাসান, তরকারিতে মশলা কম হলে বাবুর্চিকে, এমনকি নেটওয়ার্ক খারাপ হলে মোবাইল অপারেটরগুলিকে। কবিকে কি আপনারা একই ভাবে দোষেন? মনে হয় না। আপনারা কবিকে চিনলে পরে তো কবির দোষ ধরবেন।
আপনারা বলেন কবি দুর্বোধ্য। অস্পষ্ট। বিভ্রান্তিকর। আমি বলি, আপনাদের এমনিতেই কি বিভ্রান্তির শেষ আছে? ডান বান, পূর্ব-পশ্চিম ঠিকঠাক জানেন তো? অস্পষ্ট আপনাদের আইন। দুর্বোধ্য আপনাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের রীতি-নীতি, এমনকি বিভ্রান্তিকর আপনাদের ভাষাও। এর মাঝে কবি জন্য নতুন কী ভ্রান্তির?
ভাবছেন, আদিখ্যেতা করি কবিকে নিয়ে। তবে সংক্ষেপে বলিঃ
এক যুগের কথা। ইন্দ্রপ্রস্থ নগরের কবি। কবির বাড়ী। বাড়ীর পাশে নদী। কবি একা। কবি একা। কবি একা।
2 comments:
pore valo laglo.
thank you vaiya :)
Post a Comment