Friday, October 24, 2008

অ স চে ত ন তা

তীব্রভাবে অসচেতনতা টের পাচ্ছি বা অনুভব করছি বলাটা ঠিক হবে না। তার কারণ হলো, কার্যকারণ সুত্রের যথবিহিত শিক্ষানুযায়ী আমি প্রতিকারের চেষ্টা চালাতাম। এখন বলা যাক অনুমান করছি। মোবাইল ফোন ছিল পকেটে। আমি ছিলাম রিক্সায়। কল আসল। রিসিভ করার সময় ছিলো হাতে। এর পর কল কাটা পর্যন্ত মনে আছে মোবাইলটা হাতেই ছিল। কই গেল জানি না। প্রতিদিনই তো পকেট থেকে বের করি, আবার পকেটে রাখি। জিন্সের প্যান্ট, সুতি প্যান্ট, হাফ প্যান্ট, এমনকি লুঙ্গি পড়া অবস্থায়ও কখনো মোবাইল হারাই নি। কয়েকদিন আগে এক বন্ধু প্রায় হুবুহু একই কায়দায় মোবাইল হারাল কাঁঠালবাগানে। আমি হারালাম খিলগাঁও রেলগেটের পর। ঐ বন্ধুটিকে তিরস্কার করেছিলাম তার অসচেতনতার জন্য। গতকাল রাতে আমি তার চরম নিদর্শন দেখালাম। কি আর করার। নতুন সিম তুলতে হবে, সেটও কিনতে হবে। নম্বরগুলিও গেছে। ভালোই হলো বোধ হয়...

আমি একটা লেখা পড়ছিলাম পাভলভের উপর। আই. পি. পাভলভ। বস্তুবাদী শারীরতত্ত্ববিদ। লেখাটা রিফ্লেক্স নিয়ে। প্রতিবর্ত ক্রিয়া। সংবেদন আর প্রতিবর্তের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন পাভলভ। আমাদের মনের গাঠনিক অবস্থা ও ক্রিয়াকলাপের ব্যাখ্যা যদি পাওয়া যায়, আহা রে। ইন্দ্রিয় পেলাম ৫টা। ব্যবহার করে, সেই সাথে সংবেদন প্রণালীর ব্যবহার, তাও কি যা দেখছি, যা অনুভব করছি তার যথার্থ অনুবাদ করতে পারছি? অনুমান করি, তাও নিজের সচেতনতা ও সমন্বয়ের উপর প্রায় শতভাগ আস্থা রেখে। কথা বলি, শব্দ চয়ন করি, এমনকি অন্যের সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করি অনুমানের উপর। কতগুলি প্রকল্পের উপর, আবার যে প্রকল্পগুলি সম্বন্ধে আমি নিজেই নিশ্চিতভাবে জানি না, তাদের উপর ভিত্তি করে যুক্তি দাড় করাই, অনুকল্প দাঁড়িয়ে যায়, তা নিয়ে অহংকারও করি। বোধ হয় তাই নিয়ে বেঁচে আছি। রিফ্লেক্সের বড়াই আর স্মৃতির উপর আস্থা নিয়ে ভালোই চলছিল। কিন্তু গতকালের মোবাইল হারানো আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

পাভলভের সুত্র জানি আর না জানি, এটা তো ঠিক যে আমি মনের গতিবিধি না বুঝলেও, এটা দাবি করি যে, যা ঘটছে তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অংশ যার প্রতি আমি মনোযোগ দিচ্ছি তার নিয়ন্ত্রণ আমার কাছেই। আবার প্রতিদিনের এই মোবাইল পকেট থেকে বের করা আর পকেটে রাখা সংক্রান্ত প্রতিবর্তটি যে এতদিনে খুব ভালোভাবেই রপ্ত ছিলো তাই নয়, সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল এক আত্মবিশ্বাস যার উপর ভিত্তি করে বন্ধুটিকে লাগিয়েছিলাম ঝাড়ি। হায়রে কপাল।

বিভিন্ন বিষয় ও সেই সংক্রান্ত ধারণা নিয়ে প্রায়ই তো তর্কে জড়াচ্ছি বন্ধু-বান্ধব স্বল্প পরিচিত, এমন কি অপরিচিত লোকের সাথেও। কিন্তু যে সচেতনতার উপর ভর করে আমি শব্দ ব্যবহার করি, চিন্তা করি, ধারণাসমূহের লালনপালন করি, তার ভিত্তি কতটুকু, নাকি মোবাইল হারানোর পর যেমন প্রতিবর্তহীনতা এমনকি মোবাইল যে পকেটে নেই সেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যাপারটিও যে অতিন্দ্রিয় হয়ে উঠলো, তেমনি এক দিন টের পাবো আমার বিশ্ববিক্ষণের উপায়গুলিতেও রয়েছে অদ্ভুত মৌলিক দুর্বলতা। হায় রে। আমরা এমনই অসচেতন যে অসচেতনতা টেরও পাই না।

একটা সুফি গল্প মনে পড়ছে। দুই মাছ, এক মাছ তরুন সে উৎফুল্ল। আরেক প্রবীন নাস্তিক মাছ তাকে সাবধান করে বলছে, "তুমি এত উৎফুল্ল কেন? চারপাশে যা দেখছ, তার রঙিন সমুদ্র কি না, তুমি কি নিশ্চিত?" তরুন মাছ বলে, "আমি কি করে জানবো? আমি তো এই সমুদ্রের বাইরে কখনো যাই নি।" প্রবীন মাছ বলে, "না জেনেই তুমি এত আনন্দে? আগে জানার চেষ্টা কর, এর পর আনন্দ কর। নিচের দিকে চেয়ে দেখ।" তরুন মাছটি সমুদ্রের তলদেশের অন্ধকার দেখলো এবং বিভ্রান্ত হলো। আর কোনদিন সে সুখী হতে পারলো না। তার সমগ্র সচেতনতা দিয়েও সে এই মহাসমুদ্রকে বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। যে সমুদ্রে সে বাস করে, তাকে সে সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে অসমর্থ।

কোথায় যে আমাদের চিন্তায় সমস্যা, তা আমরা সঠিকভাবে জানতে পারি না বলেই আমরা একটা নির্দিষ্ট গভীরতায় পৌছানোর পর চিন্তাকে আর প্রসারিত করতে পারি না। এমন কি যেসব শব্দ ব্যবহার করে আমরা চিন্তা করি তাদের সম্বন্ধেও আমরা সচেতন নই। ফলে আমাদের চিন্তার ফসল যেসব শব্দ, সেই সব শব্দের অসচেতন ব্যবহার ও শিক্ষা আমাদের চিন্তাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একটা সময়ের পর হয়তো আসলে আমাদের মন আর "খালি খাতা" হতে পারে না। ভাষা চিন্তাকে ও চিন্তা ভাষা তৈরী করতে থাকে। বস্তু ও চেতনার এই চিরন্তন রহস্য আমাদের অসহায় করতে থাকে। আর এর মধ্যে যাও আমাদের বোধ তৈরী হয়, তার মধ্যে সমন্বয়ের আগেই আমরা আবিষ্কার করি আমাদের সীমাবদ্ধতা, সসচেতনতা। যার ফলে সত্যকে আমরা প্রথমেই ভুল ভাবে নিই। "seeing is believing" এই কথাটা তখনই সত্যি যখন আমরা যা দেখছি তা সচেতন ভাবে দেখতে শিখি এবং সমন্বয় করতে পারি প্রকল্পসমুহের সাথে।

No comments: