ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২১
কলম্বিয়া নদীতে একটা জাহাজ চলছে, সেই দৃশ্য দিয়ে সিনেমার শুরু। পর্দার বাম থেকে জাহজটা তার স্বাভাবিক গতি নিয়ে পর্দার ডান পর্যন্ত যায়। জাহাজের ইঞ্জিন অতি আধুনিক, আকার প্রকান্ড। একই নদী আমরা যদি দুশ বা আড়াইশ বছর পেছনে গিয়ে দেখি, দেখবো আরেকটা জাহাজ। এটিও বাম থেকে ডানে ধীর গতিতে পার করবে, এই ইঞ্জিন আরেকটু ধীর হতে পারে। জীবনের অতি স্বাভাবিক গতিকে অতিক্রম করার উপায় নেই। ফিকশন, সিনেমায়, গল্পে, উপন্যাসে এমনকি বাস্তবে, কোন ইঞ্জিনই জীবনকে দ্রুতগামী করতে পারে না। ফার্স্ট কাউ সিনেমার প্রথম কয়েকটি দৃশ্য।
আমেরিকার উত্তরের ওরেগনের একটি ট্রেডিং পোস্ট এই সিনেমার গল্পের কেন্দ্রে। ট্রেডিং পোস্ট মানে সেই পুরানো দিনে, আমেরিকার পশ্চিম তখনো ইউরোপীয় সেটেলাররা পুরোপুরি দখলে আনতে পারে নি । যখন জীবন ধীর ছিল বললে আমরা আর আপত্তি করি না। ইউরোপে তখন পুঁজির ঢেউ লেগেছে, নতুন পৃথিবীর পশ্চিম বাকী পৃথিবীর মানুষেরা জয় করতে এসেছে। কোষে কোষে এখনো প্রাক-কৃষি যুগের ডিএনএ। সিনেমার মূল চরিত্র ফিগোউইতজ ওরফে কুকি প্রাক-কৃষি যুগের সংগ্রাহক গোছের, এই নতুন দুনিয়াতে রান্না ও রুটি ইত্যাদি বেকারী সামগ্রীর তৈয়ারে পারঙ্গম। বীভার শিকারী একটা দলের খোরাক যোগানোর কাজে নিযুক্ত হয়ে সেই দলের সাথে আমেরিকার পশ্চিম তীরের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্যারিসে তখন বীভারের চামড়ার হ্যাটের ফ্যাশন পড়ন্ত। নতুন ফ্যাশন কী হবে সেই দুর্ভাবনা করতে দেখি হাজার মাইল দূরের নেটিভ আমেরিকার সর্দারকে। কে বলে জীবন ধীরগতির!
জঙ্গলে মাশরুম খুঁজতে গিয়ে কুকি ফিগোউইতজ এর সাথে দেখা হয় চৈনিক কিং লুর। কিংলু ডায়াস্পোরা, ম্যারিল্যান্ডের কুকিও এক অর্থে ডায়াস্পোরা। ইউরোপীয়, চৈনিক, নিগ্রো, নেটিভ, ইহুদী, মুসলমান, ইন্ডিয়ান, আরব, গরীব, দুঃখী, ডায়াস্পোরা ইত্যাদি। কিংলু কুকির চেয়েও ভালো ইংরেজি বলে, অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান ও কুশলী, ক্যাপিটালিজম এর স্বপ্ন তার দুইচোখে, সান ফ্রান্সিসকোতে গিয়ে নতুন হোটেল খুলতে চায়। ক্যান্টন থেকে জাহাজে চড়ে লন্ডন ঘুরে ওরেগন পৌছেছে এই ডায়াস্পোরা। রাশিয়ান রা তার পিছু নিয়েছিলো। কুকি তার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। ফার্স্ট কাউ বন্ধুত্বের গল্প।
এই বাণিজ্য কেন্দ্রটিতে আমরা অনেক জাতের মানুষকে দেখতে পাই যারা সংগ্রামে লিপ্ত, জীবনের প্রত্যেকটি দিন ধীর গতিতে আগাচ্ছে, একটা দিনের পরে আরেক দিন টিকে থাকাই জটিল ও কঠিন। ডিরেক্টর চিত্রনাট্যের শৈল্পিক ধীরতায় পটভূমির মধ্যে নিয়ে আসেন কলম্বিয়া নদীর ধার, অরণ্য, কুটির, বাজার, বাজারের প্রাঙ্গনের কাঁদা, মানুষের অনিশ্চিত সংগ্রাম, তার মধ্যে ক্ষমতা ও সভ্যতার দ্বন্দ্ব। ঔপনিবেশিক চিফ এই ক্ষমতার পিরামিডের উপরে বসে আছেন, বাকীরা প্রায় নাই বললেই হয়। ওরেগনের এই আদিম কাঁদার পৃথিবীতে তার ক্ষমতা তাকেই শুধু লন্ডন (যা কিনা ততকালীন বিশ্বের তথাকথিত সভ্যতার উৎকর্ষের কেন্দ্র) এর আরাম আয়েশের কথা ভাবার সুযোগ দেয়। তার ইচ্ছে হয়, ইংলিশ চা পানের, লিকারের সাথে কিঞ্চিৎ গোদুগ্ধ। এর ফলেই সিনেমার হাজির হয় কেন্দ্রীয় আরেক প্রধান চরিত্র, গরু! প্রথম গরু, ফার্স্ট কাউ।
কলম্বিয়া নদী ধরে একটা ভেলা বা ফেরীতে করে এক দিন হাজির হয় গরুটা। পথে তার স্বামী ও সন্তানের মৃত্যু ঘটেছে। এই দুগ্ধবতীকে কেন্দ্র করেই এর পর আগাতে থাকে মানুষের আগ্রহ, সিনেমার গল্প।
ছোট বাণিজ্য কেন্দ্রটিতে পরিবর্তন আসছে। গরু চলে আসা একটা লক্ষণ। সেই গরু ঘাসের গালিচায় বাধা থাকে। তাকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত হয় শ্রমিক। কুকি রান্নায় পারদর্শী। একদিন কিংলুর মাথায় বুদ্ধি আসে, গরুর দুধ চুরি করার। চুরি করা অল্প দুধে কুকি বানায় বিস্কুট। সেই সুস্বাদু বিস্কুট খেয়ে কিংলু ব্যাবসার বুদ্ধি আটে।
এখানে এক পেগ হুইস্কির দাম দুই সিলভার। অত্র এলাকার মানুষ বহু বহু দিনের গরুর দুধের স্বাদ কী জানে না। কিছু মধু, দারুচিনি, ইত্যাদি সংগ্রহ করে কুকি আর কিংলু প্রথম দিন তৈরি করে ছয়টা তেলের পিঠা। বাজারে গিয়ে বসে যায় সেই ছয়টা পিঠা নিয়ে। বুদ্ধিমান কিংলুর কারণে বেশ ভালো দাম পায় সবকিছুর। উৎসাহিত হয়ে তাদের দুধ চুরি এবং তেলের পিঠা কার্যক্রম চলতে থাকে। কিংলু খুব বুদ্ধি করে যোগান সীমাবদ্ধ রেখে তেলের পিঠার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক লাভ হয়ে যায় অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই। ক্যালিফোর্নিয়াতে তখন অঢেল সুযোগ। অল্প টাকায় জমি পাওয়া যায়। দুই বন্ধু স্বপ্ন দেখতে শুরু করে কৃষি খামারের। প্রাক-কৃষি মানবের ধমনীতে পুঁজির আনন্দ।
রাতের বেলা কুকি প্রতিদিন যায় দুধ চুরি করতে। গাছে উঠে কিংলু পাহারা দেয়। আমাদের প্রাক-কৃষি মানব কুকি, প্রতিদিন গরুর কাছ থেকে অনুমতি নেয়, তার স্বামী ও সন্তানের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। গরু সম্ভবত সেই প্রথম দিকের প্রাণীগুলির একটা যারা মানুষের সাথে কৃষি যুগে প্রবেশ করেছিল। কুকির কথা যেন বুঝতে পারে গরুটা। লেজ নাড়ায়, মাথা নেড়ে সায় দেয়। এক সাথে পুঁজিবাদের সংগ্রামে সাথী হয়।
সুস্বাদু তেলের পিঠা খুব দ্রুতই মনোযোগ কাড়ে চিফের। চিফ কুকিকে ব্যাক্তিগত কাজে লাগায়। তার এক অতিথির জন্য ব্লুবেরি ক্ল্যাফোটিস বানানোর কাজ দেয়। কুকির রান্নায় খুব খুশি হয়ে চিফ তাকে গরু দেখাতে নিয়ে যায়। কুকিকে দেখে গরুটা স্বাভাবিকভাবেই লেজ নাড়ায়, মাথা এগিয়ে দেয় আদরের সাথে। চীফ ও অন্যান্যরা সন্দেহের চোখে দেখে, কিংলু ও কুকি প্রমাদ গোনে। এ যাত্রা বেঁচে যায় দুইজনেই। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে তো!
গল্পের এই জায়গা থেকে আমরা কোন পরিণতির দিকে যেতে চাই ঠিক করে নিতে পারি, বা চাইলে সিনেমাটাও দেখা যেতে পারে গল্পের খাতিরে। পাশেই কলম্বিয়া নদী, কুকি আর কিংলু চাইলে নদীর ভাটিতে পালাতে পারে, অন্যদিকে চিফের আছে বন্দুকবাজ বাহিনী। এই ঔপনিবেশিক ও পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার ন্যায়-অন্যায় সব চীফের পক্ষে। চৈনিক কিংলুর এর মতন এলিয়েন (জেনোফোবিক আমেরিকায়/পৃথিবীতে) আর কুকির মতন দুর্বল-পুঁজিহীন-অর্বাচিন যে অন্যায় করেছে দুধ সংগ্রহ করে তার কী শাস্তি বিধান করা যায়? দুইশ বছর পরের এই পৃথিবীতে কি গল্পটা ভিন্ন হবে? বা আজ থেকে দুইশ বছর পরে আমাদের কবর খুড়ে যারা আমাদের অস্থি-কঙ্কাল আবিষ্কার করবে তারা আমাদের ন্যায়-অন্যায়ের জন্য কি শাস্তি বিধান করবে? সেই নতুন পৃথিবীতে প্রাক-কৃষি মানব, গুহামানবের অধিকার থাকবে তো?
জোনাথন রেমন্ডের গল্পে পরিচালক কেলী রাইকার্ডের সিনেমা ফার্স্ট কাউ। সিনেমাটির শৈল্পিক ধীরগতির কথা বলেছি, কিন্তু এই ধীরগতি নিয়েই ক্লাইম্যাক্স এর দিকে নিয়ে যায় চিত্রনাট্য, থ্রিলার বলা যায় প্রায়। সেই ঊনবিংশ শতকের শুরুর আমেরিকার ওয়েস্ট তার জীবন ও মানুষ, তার দৈনন্দিন ভাবনা, বেঁচে থাকা, বন্ধুত্ব, ইত্যাদি নিয়ে এই ছবি। পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিবে। কত পুরানো? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য বর্তমানের উত্তর-ঔপনিবেশিক / নিও লিবারেল মানুষের অবসর প্রয়োজন।