Sunday, November 03, 2013

ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাক্টিস করো

'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো' - ঋত্বিক ঘটকের শেষ ছবি। অনেকে এটিকে তার আত্মজীবনীমূলক ছবি বলতে চান। ঋত্বিক নিজে এই ছবিতে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। আরো অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত প্রমুখ। কাহিনী আবর্তিত হয় নীলকন্ঠ বাগচী নামের চরিত্রকে ঘিরে।

কে এই নীল কন্ঠ বাগচী? তার নিজের ভাষায় "আমি একজন ক্ষয় প্রাপ্ত বুদ্ধিজীবি"। নকশাল ছেলেরা অভিহিত করছে, "লোকটা ফেমাস ছিলো, কিন্তু কোন পলিটিক্স নেই।" নীল কন্ঠ বাগচী এমন এক পরিণতি যা ঋত্বিকের শেষ জীবনে আমরা দেখি, পার্থক্য শুধু নীলকন্ঠ বাগচী পুলিশের সাথে নকশালদের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে মারা যান।

সারাদিন মদ গিলেন। এর মধ্যে এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ পন্ডিতকে জিজ্ঞেস করছেন, "আমার কাছে সুধা আছে, চাই কি?" কিসের সুধা এটা? দুই বাংলার মিলনকামী ঋত্বিক এবং নিলকন্ঠ বাগচী দুজনেই। অথচ ১৯৭১ এবং তার অব্যবহিত পরে যখন দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মিলনের তথাকথিত সুযোগ এসেছে বলে বুদ্ধিজীবীরা(জৈবিক নয়) চিৎকার করছেন, চিন্তার রাজ্যে ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন, উপন্যাস-কবিতা-নাটকের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন তখন তিনি প্রকৃত অবস্থার অনুধাবন করেই কি মদে ডুবে আছেন?

সুশীল লেখক সত্যজিৎ বসু যখন তাকে বলছেন বাংলাদেশ নিয়ে তার ভাবনার কথা, নীলকন্ঠ বাগচীর কন্ঠে তখন চরম উপহাস, "ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাক্টিস করো। " এই উপহাস সেই সব অজৈবনিক(ইনর্গানিক) বুদ্ধিজীবীদের প্রতি। ভারতের অন্তর্ভূক্ত বাংলায় আগত এক পূর্ব পাকিস্তানী উদ্বাস্তুকে বলছেন, "কে মা তুমি? তুমি কি আমার বাংলাদেশের আত্মা? যে বাংলাদেশের এখনো জন্ম হয় নি?" এ জায়গাটাতে আমার মনে পড়ে আহমদ ছফার কথা। আহমদ ছফার মত ঋত্বিকও কি বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালির মুক্তির সোপান আরো বহু দূরে।

নকশালরা যখন দাবি করল, তিনি আসলে ক্ষয়প্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী, তখন তিনি অকপটে স্বীকার করছেন, "ধরে ফেলেচ?"। বলছেন, "তোমরা হলে এই জেনারেশনের ক্রীম, ...শিকড়টাকে তো উপরাতে হবে...কিন্তু..."। সমাজ পরিবর্তনের অদম্য ইচ্ছা তার মধ্যেও ছিল, কিন্তু সমাজেই যেন তার ঠাঁই নেই। ঋত্বিকের শেষ জীবনও তো কেটেছে রাচীর মানসিক হাসপাতালে।

[সামু ব্লগ থেকে, পুরানো লেখা]