Monday, March 21, 2011

জীবন টুকরো জীবন

কপিসূত্র: মামুন জিফরান

অ্যাম্বিশন ছিল, মুচি হবেন। বিদেশে ট্রাক-ড্রাইভারির পরীক্ষা দিয়েছেন। পুষবেন বলে সাপ ধরে এনেছিলেন। স্লো সাইকেল রেসে চ্যাম্পিয়ন। বাংলা কবিতার মহারথী। আলগোছে কিছু জীবন বললেন



উৎপলকুমার বসু

আমি জন্মেছি কলকাতায়, ভবানীপুরে। ছেলেবেলায় মা’কে হারাই, তার পর আমার এক নিঃসন্তান মাসি আমাকে নিয়ে যান দিনহাটা। কুচবিহারে। আমাকে মাসিই মানুষ করেন। দিনহাটা হাইস্কুলে ক্লাস থ্রি থেকে পড়েছি। ওই স্কুলে আমাদের এক জন মাস্টারমশাই ছিলেন কমল গুহ, আমাদের রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী। দিনহাটার আর এক জন বিখ্যাত ছেলে পেয়ারাদা, ভাল নাম এরশাদ, পরে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ভারতবর্ষ তখন স্বাধীন হব হব। কুচবিহারের রাজা রাস্তা দিয়ে গেলে সামনে রাস্তায় ঝাঁট পড়ত। তার পর বিউগিল বাজাতে বাজাতে এক দল যেত, তার পর সেপাইসহ রাজা যেতেন, শেষে আমরা রাস্তা নোংরা করতে করতে।

বাড়ির কাছেই স্কুল ছিল। হেঁটেই যাতায়াত করতাম। টিফিন খেতে বাড়িতে আসতাম। যেহেতু আমি শহর থেকে গেছি, তাই একটু নিঃসঙ্গ ছিলাম, বন্ধুবান্ধব বিশেষ ছিল না। কিন্তু আমার নিজের একটা ছোট চিড়িয়াখানা ছিল। সেখানে কুকুরছানা বেড়ালছানা থেকে আরম্ভ করে পাখি, পোকামাকড়, শিশির মধ্যে গিরগিটি ছিল। একটা পাহাড়ি ময়না ছিল। বাবু টাইপের। রোজ দুপুরে বলত— স্নান করব, স্নান করব। তখন তাকে স্নান করাতে হত। মাসি অসম্ভব রেগে গেল যখন আমি একটা সাপ ধরে আনলাম পোষার জন্য। বলল, আর না, ঢের হয়েছে।

আমার একটা আলাদা ঘর ছিল। শীতকালে প্রিয় কুকুরগুলো পছন্দ করত আমার ঘরে এসে শুতে। আর মাসি এসে তাদের ঘর থেকে বের করে দিত রাত্তিরবেলায়। একটা কুকুর ছিল খুব পাজি, সে পায়ের কাছে এসে শুয়ে থাকত লেপের তলায়, মাসি টের পেত না। অন্য কুকুরগুলোকে বের করে দিলেও, ওকে দেখতে পেত না। ও একটা বালিশের মতো পড়ে থাকত। তো মাসি তো দরজাটরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেছে। রাত্রিবেলায় বহু দূরে কুকুর ডাকছে। ব্যস, এ ব্যাটাও আমার বিছানা থেকে ডাকতে শুরু করেছে। আর মাসি উঠে এসে বকাবকি— উৎপল কুকুর বার কর কুকুর বার কর। এখন ভাবি ওটা কুকুর ছিল না শাজাহানি শেয়াল!

ছুটির দিন আমার কাজ ছিল সারা বাড়ির সব জিনিসপত্র পরিষ্কার করা। বিশেষ করে সাইকেল। শুধু আমার সাইকেল না, বাড়ির সবার, এমনকী পাড়ার অনেকেরই সাইকেল পরিষ্কার করতাম। বিনি পয়সায়। ওগুলো ছিল আমার শখের কাজ। নাটবল্টু খুলেটুলে দিয়ে তেলটেল দিয়ে পরিষ্কার করে রেডি করে দিতাম। হাফ-মেকানিক! এ ছাড়া বাড়ি আর পাড়ার লোকের চামড়ার বেল্ট, জুতো পালিশ করা খুব ফেভারিট কাজ ছিল। আসলে ছেলেবেলা থেকে আমার একটা অ্যাম্বিশনও ছিল মুচি হওয়ার। বাড়ির লোকেরা অবশ্য খুব পছন্দ করতেন না অ্যাম্বিশনটা। আর একটু বড় হয়ে শখ হল, ট্রাক-ড্রাইভার হব। স্বপ্নটা আজও আছে। আমি বিদেশে ট্রাক-ড্রাইভারির পরীক্ষাও দিয়েছি। লাইসেন্স আছে। এ সব লেখালিখি, পড়াশোনা, এগুলো আমার খুব একটা মনোমত নয়। অপুর সঙ্গে অমিল আছে আমার— অপুর দিদি ছিল, আমার আছে বোন।

ক্লাস এইটে একটা নতুন সাইকেল হল। সে একেবারে আমার স্বপ্ন। কুকুরটুকুর বাদ দিয়ে সাইকেলটাকে মাথার কাছে নিয়ে শুতাম। এখনও আমি ভীষণ সাইকেলের ভক্ত। কিছু দিন আগেও শান্তিনিকেতনে থাকতাম একটা ঘর ভাড়া করে, ওখানে গিয়ে আমার প্রথম কাজ ছিল একটা সাইকেল কিনে ফেলা। আমরা সব সাইকেল চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। আমি আবার যাতে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম তার নাম ছিল ‘স্লো সাইকেল রেস’। সেটা হচ্ছে, একটা সাইকেলে চড়ে এ দিক ও দিক করে যত ক্ষণ পারা যায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। পড়ে গেলে চলবে না। এটায় আমাকে কেউ বিট করতে পারত না। এখনও আমি ভীষণ স্লো সব ব্যাপারে। স্লোনেস হচ্ছে আমার একটা ধর্ম।

স্কটিশে ভর্তি হলাম আই এস সি পড়ার জন্য। তখন আমার বন্ধুরা ছিল আনন্দ বাগচি, দীপক মজুমদার। আমার বিষয় ছিল বিজ্ঞান। আশুতোষ থেকে বি এসসি করলাম, এম এসসি প্রেসিডেন্সি থেকে। চার বছর পড়িয়েছি আশুতোষ কলেজ থেকে ভূতত্ত্ব।

স্কটিশে পড়ার সময় বোধহয় আনন্দ বাগচির প্রেরণায় ‘দেশ’-এ একটা কবিতা পাঠাই। সেটা পুজোসংখ্যায় ছাপা হয়। যদ্দূর মনে পড়ে ওটাই প্রথম ছাপা কবিতা। তখন পূর্বাশাতেও একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। যাকগে, সুতারকিন ষ্ট্রিটে তো দেশ পুজোসংখ্যা আনতে গেলাম। ওরা বলল যে আপনার টাকাটা পাঠিয়ে দেওয়া হবে এক মাস পরে। কবিতা লিখে যে টাকা পাওয়া যায় এটা অবিশ্বাস্য ছিল। আমি ভাবলাম এই টাকা যদি বাড়িতে আসে তা হলে তো বাবা একেবারে রেগে আগুন হয়ে যাবেন! বোনকে বললাম, একটা পোস্টম্যান আসবে, তুই সই করে পঁচিশ টাকা নিয়ে নিবি, বাবা যেন জানতে না পারে। সে পোস্টম্যান তো মানি-অর্ডার নিয়ে বাবার কাছেই গেল। মানি-অর্ডারের নীচে বিশদ লেখা। বাবা প্রথমে বললেন, এটা ভুল ঠিকানায় এসেছে। তার পর ভাল করে দেখেটেখে বললেন, এ কী! ছেলে কবিতা লেখে! বাবার একটা আড্ডা ছিল বাড়িতেই। ওখানে কালিদাস রায়কেও আসতে দেখেছি। তো কালিদাস রায় লেখা দেখে বললেন, এই সব কী হাবিজাবি লেখে? একটা লাইনও তো বুঝতে পারলাম না!

ওই পঁচিশ টাকায় সে কী আনন্দ! সাংগুভেলি-তে বন্ধুরা মিলে খেলাম চপ-কাটলেট-চা। তাতেও টাকা বেঁচে গেল, বাড়িতে বাজারটাজার হল এক দিন। তাও বেঁচে গেল টাকা। সিগনেট বুকশপ থেকে কয়েকটা কবিতার বই কিনলাম। জীবনানন্দ, অমিয় চক্রবর্তী। তাও ফুরোয় না। এক পয়সার তৈল-র মতো ব্যাপার। প্রচুর ব্যয় হইল। সে অবিস্মরণীয়।

তার পর ‘কৃত্তিবাস’। কৃত্তিবাসে প্রথম তিন জন সম্পাদক ছিলেন আনন্দ বাগচি, দীপক মজুমদার আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। দক্ষিণ কলকাতার গড়চা থেকে ‘ইদানীং’ বলে একটা কাগজ বেরোত। তারা লিখল, উত্তর কলকাতায় কৃত্তিবাস বলে একটা গোষ্ঠী হয়েছে, তারা নাকি খুব উচ্ছৃঙ্খল, তারা নাকি খুব হ্যান করে ত্যান করে। তাদেরকে আমরা চ্যালেঞ্জ করছি, তারা এক দিন দক্ষিণ কলকাতায় আসুক, এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করুক। সে তো একটা মারামারি হওয়ার অবস্থা। দেখে নেব, এই সব। এক দিন আমি দক্ষিণ কলকাতা থেকে উত্তর কলকাতায় গিয়ে ওদের সঙ্গে মিলে ফের চললাম দক্ষিণ কলকাতায়। টু-বি বাসে চড়ে গিয়েছিলাম, মনে আছে। সন্দীপন-শক্তি তখনও কৃত্তিবাসে আসেনি। আমরা ইদানীং-দের সঙ্গে দেখা করলাম ‘আলফা কাফে’-তে। আমরা তো ভেবেছিলাম বিরাট লড়াইটড়াই হবে, তা না, আধ ঘণ্টার মধ্যে এমন বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে আমরা দুপুরে বাড়ি ফিরলাম না। ওইখানেই শঙ্কর না কার বাড়িতে খাওয়াদাওয়া হল, আড্ডা হল রাত ন’টা পর্যন্ত। এই করে শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দক্ষিণের এই সব ছেলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল। আমরা খুব মহুয়া খেতাম হাঁড়িয়া খেতাম। পরে শক্তি শিখিয়েছিল, মহুয়া খাওয়ার আগে বেশ খানিকটা মহুয়া সারা গায়ে তেলের মতন মেখে নিবি। নেশা জমবে।

এর পর বোনের বিয়ে হয়ে গেল। বাবাও মারা গেলেন। আমিও চাকরি ছেড়ে বাড়ি বেচে প্যারিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। প্যারিসের টিকিট ছাড়া আমার হাতে তখন তিন পাউণ্ড। তখনকার হিসেবে আটচল্লিশ টাকা। প্যারিসে যোগেন চৌধুরীর হোস্টেলের ঘরে লুকিয়ে থাকতাম। ওদের হোস্টেলে একটা ঘরে এক জনের বেশি থাকার নিয়ম ছিল না। পেছনে একটা খিড়কি দরজা ছিল, ওটা দিয়ে সকাল হলেই বেরিয়ে চলে যেতাম। পকেটে তো পয়সা নেই। অল্প কয়েকটা খুচরো পয়সায় সারা দিন প্যারিসের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভিখিরির মতন...। আমি প্যারিসকে যে ভাবে দেখেছি, খুব কম বাঙালি দেখেছে। দুপুরে খাওয়া একটা দুর্লভ ব্যাপার ছিল। রাস্তার পাশে চিনেবাদাম-টাদাম খেয়ে, রাত্তিরবেলায় এসে যোগেনের ঘরে ভাত ডিমসেদ্ধ আলুসেদ্ধ মাখন-টাখন দিয়ে চটকে-মটকে খেতাম। তার পর সবার সঙ্গে হইহই করে আড্ডা দিয়ে অনেক রাত্রে ঘুম।

তখন শীতকাল চলছিল। নতুন বছর আসছে। ভাবলাম, লণ্ডন যাই, কাজ পাব। যে ভাবে চা-বাগানের শ্রমিকরা যায়। ‘চল মিনি আসাম যাব, আসাম গেলে নোকরি পাব।’ আমি লণ্ডনে এক সময় এমনকী জাল পাসপোর্টের চক্রেও জড়িয়েছিলাম! জানি না এখন শুনলে আমাকে ধরবে কি না। হাঃ হাঃ! আমার দু’তিন জন বন্ধু ছিল, ইণ্ডিয়ান হাউসে কাজ করত। ওরাও ছিল। আমার বাড়িতে পুলিশ বেশ কয়েকবার রেড-টেডও করেছে। এই সব ব্যাপারে আমি আইনকানুন মানতে রাজি ছিলাম না।

এক রবিবার আমার বন্ধু ভাস্কর দত্ত আমাকে একটা ঘর ঠিক করে দিল। যার কাছে থাকব, সে হচ্ছে মহাত্মা গাঁধীর নাতি। প্রচণ্ড মাতাল। তার আমাকে ঘরে থাকতে দেওয়ার একটা শর্ত ছিল— সে কাজে যাওয়ার আগে দুটো ডিমের টোস্ট, দুটো ডিমের ফ্রাই, আর এক পট চা করে দিতে হবে। ও যখন কাজ থেকে ফিরবে, তখনও এই একই খাবার বানাতে হবে। অবশ্য আমিও তা-ই খাব। থাকা-খাওয়া ফ্রি। ওর পাল্লায় পড়ে আমি বেশ মদ খাওয়া ধরলাম।

এক দিন লাইব্রেরিতে পড়তে গিয়ে একটা চাকরি পেয়ে বসলাম। অ্যাসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ান। বেশ মাইনে দিত। তো, ওরা বলল, কাজ করতে করতে লাইব্রেরিয়ানের পরীক্ষাটা দাও। আমি দেখলাম, লাইব্রেরিয়ান হওয়ার মতো বিচ্ছিরি কাজ আর দুটো নেই। ছাড়লাম। আমার জায়গায় আর একটা বাঙালি ছেলেকে ঢোকালাম। লাইব্রেরিয়ানকে সে দিন ছেলেটা সম্পর্কে প্রচুর গুল মেরেছিলাম। কাজ ছাড়ার পর দিন থেকে আবার কাজ পেয়ে যাই। ইনার লণ্ডন এডুকেশন অথরিটি আমাকে পড়াতে বলে। ছুটির দিনগুলো বড় আরামে কাটাতাম তখন। দুপুর দুটোর সময় ঘুম থেকে উঠতাম। তার পর কোনও বাঙালির বাড়িতে একসঙ্গে ভাত-মাংস রান্না হত। মদ খাওয়া, আড্ডা, হইহুল্লোড় । ইণ্ডিয়ান ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশনের লণ্ডন ব্রাঞ্চের সেক্রেটারি করল আমাকে। তখন ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। ভিয়েতনাম তখন জ্বলছে। ট্রেড ইউনিয়নগুলো সিদ্ধান্ত নিল টাকা পাঠানো হবে ভিয়েতনামে।কাজের পরে অর্থ সংগ্রহে নেমে পড়লাম।

১৯৬৮-তে উইক-এণ্ডে বাসে প্যারিস গেলাম। ইস্টারের ছুটিতে। বাস যেখানে নামিয়ে দিল, দেখি রাস্তাঘাট ফাঁকা। প্যারিস তখন উত্তাল। আমি তো কিছুই জানি না। লণ্ডনে তখন এত খবর আসেনি। দোকানপত্র লণ্ডভণ্ড, ডাস্টবিনগুলো ওল্টানো, সে এক ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্র। কাগজে পড়লাম, ছাত্র আন্দোলন। চার দিন ছিলাম। ঘুরতেই গেছিলাম পায়ে হেঁটে। কাগজে বেরোল, জাঁ পল সার্ত্র প্রোটেস্ট মুভমেন্ট করছেন ছাত্রদের নিয়ে। ফিরে এলাম লণ্ডনে। তখন লণ্ডনে আমার প্রচুর কাজ। সকাল আটটায় বেরোতাম, রাত ন’টায় ঢুকতাম। ব্যক্তিগত জীবন আর আন্দোলন এক হয়ে গেছিল। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন বাংলাদেশের কিছু কিছু নেতা আমার লণ্ডনের বাড়িতে যাতায়াত করতেন।

পুলিশের সঙ্গে পুলিশের খুব বন্ধুত্ব। ভারতীয় পুলিশ লণ্ডনের পুলিশকে আমার ওপর নজর রাখতে অনুরোধ করল। তা, এক রবিবার স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে দু’জন এসেছে প্লেন ড্রেসে। ঘরে এসে বই-পত্তর দেখে বলছে, ও ইউ আর এ ভেরি লার্নেড ম্যান। তখন আমি পরিষ্কার বললাম, দ্যাখো, আমি পোড়-খাওয়া লোক, বুঝতে পারছি, কোনও এনকোয়ারিতে এসেছ। পরিষ্কার করে বলো, আমি বলে দিচ্ছি সব। তখন ওরা বলল, হ্যাঁ, তোমার এখানে কয়েকজন আসে-টাসে। আমার বন্ধু মার্গারেট আলভা-র বোন মায়া আলভার সঙ্গে নেলসন ম্যাণ্ডেলা, ইয়াসের আরাফত এঁদের বন্ধুত্ব থাকার সুবাদে আমিও আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস, বাস্ক সেপারেটিস্ট, প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মি, আইরিশ লিবারেশন আর্মি-র সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। আমাদের ভবানীপুরের বাড়িতেও লালবাজারের লোকজন এসেছিল। আসলে, আমার বন্ধুরা কেউ কেউ বিপ্লবী, কেউ কেউ অতিবিপ্লবী, কেউ আবার প্রতিবিপ্লবী ছিল।


বিদেশে আমি ফিল্ম মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ‘ব্যাণ্ডিট কুইন’-এর লেখিকা মালা সেন, ফারুক ধোন্দি, আরও অনেকে মিলে একটা ফিল্ম ক্লাব করেছিলাম। সেটার নাম দিয়েছিলাম ‘গ্যাসলাইট সিনেমা ক্লাব’। একটা ঘুপচির মধ্যে ইঁদুর পোকামাকড় ভর্তি একটা সিনেমা হল ভাড়া নিয়েছিলাম। সেখানে শুধুমাত্র শুক্র ও শনিবার ফুল নাইট সিনেমা দেখানো হত। সেটা আস্তে আস্তে পুলিশ তুলে দিল। কেননা, ফুল নাইট বলে যত রাজ্যের ড্রাগখোর, পাতাখোর, গাঁজাখোর, মদখোর এসে ভিড় করত। ওদের কাছে দু’দিনের জন্য ওটাই ঠেক ছিল। প্রচণ্ড শীত তো, তাই দু’দিনের জন্য একটা গরম জায়গা। সবাই টিকিট কাটতও না, অর্ধেক সময়। আমরা মুক্ত মনের ছিলাম— পয়সা নেই, ঠিক আছে, ঢুকে যাও।

ঘরে শতরঞ্জি আর কয়েকটা চেয়ার থাকত। কোনও দিন চ্যাপলিন, কোনও দিন গ্রেগরি পেক, তো কোনও দিন সাইলেন্ট ফিল্ম দেখানো হত। কিন্তু মাঝে মাঝে ভোররাত্রে আমি শয়তানি করে চ্যাপলিনের দিনে গ্রেগরি পেক ঢুকিয়ে দিতাম, আর চেঁচামেচি করত হুলিগানরা। এক বার মনে আছে, সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ দেখিয়েছিলাম। সত্যজিতের ছবিকে যা গালাগালি দিত না ওরা! ‘চারুলতা’ দেখতে দেখতে ওই দৃশ্যটায়— চারুলতা ঘুরতে ঘুরতে জানলার খড়খড়ি ফাঁক করে দেখছে, তো ওরা বিরক্ত হয়ে বলছে— হোয়াই ডোন্ট ইউ গো মেক সাম টি! চিৎকার করে বলছে চারুলতাকে। যা তা গালাগাল। তার পর আমরা সত্যজিৎ দেখানো বন্ধ করে দিলাম। যত রাফিয়ান ছোটলোকেরা আসত।

কলকাতায় ফিরে এসে উঠেছিলাম গল্ফ ক্লাবে। তার পর এক চেকে মেঘমল্লার। তার পর আবার কৃত্তিবাস। আবার মারাদোনা— সুনীল। নানান ছিটলেমির গপ্পো। এখানে এসে কবিতা লিখতাম মধ্যে মধ্যে। কবিতা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা এখনও নেই, তখনও ছিল না। আমি কবিটবিদের খুব একটা গুরুত্বও দিই না। এক দিন রাত্রে মোদোমাতাল দলের লোকজনরা হইহই করে ঠিক করল উৎপলের ফ্ল্যাটে যাওয়া হবে। আমি করেছি কি, ঘোরের মাথায় ওদের নিয়ে সেকেণ্ড বিল্ডিং-এ চলে গেছি, দশ তলায়। একটা ফ্ল্যাট খোলা, তারা তো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল আমাদের। নীচে এসে গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়ালাম। বললাম, এটা তো আশ্চর্য ব্যাপার! সকালে মালপত্র নিয়ে ঢুকেছি, ফ্ল্যাটটা গেল কোথায়? সন্দীপন মহা শয়তান, বলছে, উৎপল ফ্ল্যাটই কেনেনি এখানে, ব্যাটা মিথ্যে কথা বলছে। কার না কার ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তখন শামসের আনোয়ার ছিল, ও বলল, আচ্ছা উৎপলদা, এমন হয়নি তো, আপনি ভুল করে অন্য বিল্ডিং-এ ঢুকে পড়েছেন?

আমি খুব একটা মদ খেতাম, তা নয়। তবে আমাকে সামলাতে হত বন্ধুদের। শক্তির মতো বিরাট মদ আমি খাইনি কোনও দিন। আমি, শক্তি, সুনীল, শরৎ রাত্রে কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম। সন্দীপন ওরা হাওড়ায় থাকত, তাই ওরা ন’টা নাগাদই ফিরে যেত। শক্তির একটা বিখ্যাত কবিতা আছে, সেটায়, ঝড়ের রাত্রে এক দিন আমরা সেনেটের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিলাম, তার কথা আছে। তখন সেনেট ভাঙা শুরু হয়েছে। চৌষট্টি সাল। শেষ লাইনটায় আছে চার জন চার দিকে ছিটকে গেলাম। সন্দীপন আর শক্তি বন্ধুদের বিপদে ফেলে দিত। এক দিন রাত্রে আমরা ঘুরছি কলকাতায়। পুলিশ তুলে নিয়ে গেল মুচিপাড়া থানায়। শরৎও ছিল। সকালবেলা আমাদের ছেড়ে দিচ্ছে, শক্তি হঠাৎ বলে উঠল, সুনীল তুমি একটা অতুল্যবাবুকে ফোন করে দাও তো। ব্যস, পুলিশ অমনি— ও বাবা আপনি অতুল্যবাবু দেখাচ্ছেন, এখানে সারা দিন দশটা লোক আসে অতুল্যবাবুকে দেখায়। এই এদেরকে আবার লক-আপে নিয়ে যাও। শেষে শরৎ হাতেপায়ে ধরে বলল যে, আমরা রবিবারের নাইট লাইফ দেখতে বেরিয়েছিলাম। আর আপনাদের থেকে ভাল নাইট লাইফ কারা ভাল জানে। এই সব গ্যাসট্যাস দিয়ে। পুলিশটাও তার পর বলল, কালকে আমি আপনাদের নিয়ে যাব নাইট লাইফ দেখতে। পরের দিন শরৎ গেল, আমরা আর যাইনি।

যুক্তি-তক্কো-গপ্পো দেখতে গেছি। টিনের চেয়ারে বসে দেখছি। হঠাৎ চেয়ার ভাঙার আওয়াজ। ফিরে দেখলাম ঋত্বিক মাল খেয়ে টাল। সবাই মিলে ধরাধরি করে পর্দার নীচে শুইয়ে দিলাম। যাই হোক, সন্দীপন তার পরে একটা রিভিউ করেছিল এবং ঋত্বিককে মাথায় তুলেছিল। বলেছিল, এই রকম ছবি হয়নি, হবে না পৃথিবীতে কোনও দিন, এই সব। তার পর ঋত্বিক ওকে মারবেন বলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সন্দীপন যেখানে যেখানে যায়, ঋত্বিক সেখানে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন, হ্যাঁ গো সন্দীপন এসেছিল? কেন? ‘ওকে মারব।’ ব্যাগে লাঠিও ছিল। ‘এমন প্রশংসা করেছে আমার বইয়ের, এখন লোকে দেখে তো যা তা গালাগাল দেবে আমার নামে। বলবে, সে রকম তো কিছু না।’ তো এক দিন জক-এর ঠেকে আড্ডা দিচ্ছি আমরা সবাই, ঋত্বিক এসে হাজির— সন্দীপন, শালা শুয়োরের বাচ্চা, তুমি আমার নামে এই সব লিখেছ। সন্দীপন গম্ভীর হয়ে যা বলল, দেখুন, আপনাকে একটা কথা বলি। আপনি আপনার ফিল্ম করেছেন, ভাল হয়েছে মন্দ হয়েছে সেটা অন্য কথা, আমি আমার লেখা লিখেছি। আমি আমার লেখাটাকে দাঁড় করাব, সে যে ভাবেই হোক। তাতে ঋত্বিক হেসে ফেলেছিলেন।

আর এক দিন আমি আর সন্দীপন ডাবল-ডেকার বাসে করে ওয়েলিংটন যাচ্ছি, প্রচণ্ড ভিড়। তার মধ্যেই কী করে সামনে দুটো সিট পেয়ে যাই। একতলায় উঠেই বাঁ দিকে। ধর্মতলার ওখানে একটা লোক বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে বলল, দাদা দাদা, এটা কি টু-বি বাস? তো সন্দীপন গলা বাড়িয়ে বলল, বলব না। আর লোকটা তো পারলে মারে আর কী! এদের সঙ্গে বেরনো মানে হচ্ছে রিস্ক। যা তা। যে যার নিজের মতো কার্য করে। আমরা সবাই রাজা, কিন্তু রাজা যে কাকে কখন বিপদে ফেলবে রাজা নিজেও জানে না।

লেডিস সিটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন দেখলেই সন্দীপন বলত, দাদা ওই লেডিস সিটের পাশ থেকে সরে যান তো, ওই পেছনের দিকে যান। আমি জানি আপনি কেন ওইখানে দাঁড়িয়ে আছেন। কোনও প্রয়োজন নেই গায়ে পড়ে ঝগড়া লাগানোর। পায়ে পা ঠেকিয়ে ঝগড়া। তবে সুনীল সহ্য করত সব থেকে বেশি, আসলে দলের ক্যাপ্টেন থাকলে যা হয় আর কী। হি-ম্যান!

এক বার শক্তি আর এক কবি মিলে শিয়ালদার ওখানে কি টাওয়ার হোটেল আছে, ওখানে ঘর ভাড়া নিয়ে দু’জন থাকে। আর শক্তির তো কায়দা আছে, টাওয়ারে যাচ্ছি রাত্রে খাবারদাবার অমুক তমুক। সাত দিন পর হোটেল ম্যানেজার ফোন করেছে সুনীলকে, বলছে: এই যে দু’জন আপনার ঠিকানায় এসেছে সাত দিন কোনও পয়সা দেয়নি, এদেরকে আমরা তালাচাবি দিয়ে আটকে রেখেছি। আপনি এসে টাকাকড়ি দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। তখন সুনীল সবার কাছ থেকে পাঁচ-দশ টাকা করে নিয়ে ওদের ছাড়িয়ে আনে। তার পর তো ধুন্দুমার ঝগড়া। হাতাহাতি অবধি। আমাদের বন্ধুত্ব আসলে লেখালেখির বন্ধুত্ব নয়, আমাদের হচ্ছে রণক্ষেত্রের বন্ধুত্ব।

সাক্ষাৎকার ও অনুলিখন: গৌরপ্রসাদ কর্মকার

সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ৯ বৈশাখ ১৪১৩ রবিবার ২৩ এপ্রিল ২০০৬

No comments: