Tuesday, August 26, 2008

মাহমুদ দারবিশের কবিতাঃ অবরোধ কাল



অবরোধ কাল – মাহমুদ দারবিশ
(রামাল্লা, জানুয়ারি ২০০২)

এখানে পাহাড়ের ঢালের উপর,
গোধূলি আর সময়ের উদ্যত কামানের মুখোমুখি
ধ্বসে যাওয়া বিম্বদের বাগানের কাছাকাছি,
আমরা তাই করি যা বন্দীরা করে,
আর যা কর্মহীনেরা করে,
করে যাই কামনার চাষবাস।
***
একটি দেশ প্রস্তুতি নেয় ব্রাহ্মমুহূর্তের,
আমরা সম্মূঢ় হতে থাকি
আমরা যে কাছ থেকে দেখছি বিজয়ের ক্ষণঃ
আর কোনো রাতের মধ্যে রাত জ্বালাবে না শত্রুশেল
আমাদের শত্রুরা সতর্ক, তাই জ্বেলে দেয় আলো
পাতালঘরের অন্ধকারের ভেতর।
***
এখানে কোনো “আমি” নেই।
আদম খোঁজে তার মৃত্তিকার ধূলি।
***
মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে সে বলেঃ
আর কোনো হদিসের সন্ধানে হারাবো নাঃ
মুক্ত, আমি নির্বানের কাছাকাছি।
হাতের মুঠোয় আমার পরাহকাল
জীবনকে অতিক্রম করে গিয়ে,
আবার জন্ম নিব স্বরাট আর আশ্রয়হীন,
আমার নাম হবে আশ্বিনের আকাশের নীলের অক্ষরে।
***
তুমি, দরজায় দাঁড়িয়ে থেকো না, ভেতরে এসো,
আমাদের সাথে বসে পান করো আরবের কফি
তুমিও আমাদের মত করে মানুষ
তুমি, বাড়িগুলির সদরের পথে দাঁড়িয়ে থেকো না
আমাদের ভোরবেলাগুলিতে বের হয়ে এসো
আমরাও নিশ্চিত ভাবে
তোমাদের মত করে মানুষ!
***
যখন দিগন্ত হারিয়ে যায় চরাচর, সাদা, সাদা ঘুঘুর দল
উড়ে যায়, ধুয়ে দিয়ে যায় বেহেশতের গন্ডলেখা
অবারিত পাখায় ভরে করে দীপ্তি নিয়ে ফেরে, অধিকার নিয়ে
ইথার আর উৎসবের, উঁচুতে, আরো উঁচুতে, সাদা, সাদা ঘুঘুর দল
উড়ে যায়, আহা শুধু আকাশটাই যদি
সত্য হত [দুটো বোমার মধ্যে পড়া একজন আমায় বলেছিলো]।
***
সৈন্যদের পিছনে সাইপ্রেসবন, মিনারগুলি রক্ষা করে
আকাশটাকে পতনের আগে, ইস্পাতের ঘেরাও এর
পিছনে সৈনিকেরা পেচ্ছাব করে – একটা সতর্ক ট্যাঙ্কের
চোখ ফাঁকি দিয়ে, শরতের সুবর্ণ বিভ্রান্তি শেষ হয়
রবিবারের প্রার্থনা শেষের কোলাহলের মত চওড়া রাস্তায়…
***
[একজন খুনীর প্রতি] বন্দীর মুখটাতে চেয়ে দেখো
একটু সচেতন হলেই দেখতে, গ্যাস চ্যাম্বারে
তোমার মায়ের মুখ, রাইফেলের প্রয়োজন তোমার ফুরোতো,
তুমিও মত বদলে বলতেঃ এভাবে আর
খুঁজে পাওয়া যাবে না কারো পরিচয়
***
অবরোধ হলো প্রতীক্ষার কাল
অপেক্ষা হেলানো সিঁড়িতে বসে, বিক্ষুব্ধ ঝড়ের মাঝে।
***
একা, আমরা সবাই একা, তলানির মতো নীচে পড়ে
যদি না পাই সেই ইন্দ্রধনু অবকাশ।
***
এই চক্রবালের ওপারে আমাদের ভাইয়েরা আছে।
শ্রেষ্ঠ ভাইয়েরা। যারা আমাদের ভালোবাসে। তারা দেখে আর কাঁদে।
তারপর কানে কানে, একে অন্যকে বলেঃ
“আহা, যদি ঘোষণা আসতো এই অবরোধ…” তারা শেষ না করতেইঃ
“আমাদের পরিত্যক্ত করো না, আমাদের ছেড়ে যেওনা”।
***
আমরা হারাচ্ছিঃ প্রতিদিন দুই থেকে আট জন শহীদ
আরো দশজন আহত।
আরো বিশটা বাড়ি।
আরো পঞ্চাশটা জলপাই গাছ…
যুক্ত হয় এই নিরন্তর ধ্বংসের মাঝে
যুক্ত হয় কবিতায়, নাটকে আর অসমাপ্ত ক্যানভাসে।
***
মেঘের কাছে এক নারীর আকুতিঃ জড়িয়ে ধরো আমার প্রিয়তমকে
আমার সারা দেহ যে তারই রক্তে স্নাত।
***
প্রিয়, তুমি যদি বৃষ্টি না হও
তবে বৃক্ষ হও
ফলদ সন্তষ্টিতে, বৃক্ষ হও
প্রিয়, তুমি যদি বৃক্ষ না হও
তবে পাষাণ হও
আর্দ্রতার সম্পৃক্তিতে, পাষাণ হও
প্রিয়, তুমি যদি পাষাণ না হও
তবে চাঁদ হও
ভালোবাসার নারীর সুখস্বপ্নে, চাঁদ হও
[পুত্রের জানাজায় তার প্রতি এক মা]
***
হে প্রহরী, তোমায় কি ক্লান্ত করেনি
আমাদের জন্য প্রতিদিনের মরুপ্রতীক্ষা
আর আমাদের ক্ষতের মধ্যে জেগে উঠা বিকীর্ণ গোলাপ
হে প্রহরী,তুমি কি ক্লান্ত নও।
***
এই অসীম নীলের একটুকু ছোঁয়া
লাঘব করে দিতে পারে
এই সময়ের ভার
ধুঁয়ে দিতে পারে
এখানকার পাঁক।
***
কোথায় সে অস্তিত্ব, শীর্ষপতনের পর
নেমে এসে কোমল পায়ে
আমার পাশাপাশি, হাতে হাত, ঠিক যেমন, পুরানো
দুই সখা, যারা পবিত্র রুটি ভাগ করেছিলো
আর সেই পুরাতন পানপাত্রে সুরা
আবার এই পথে আমরা হেটে যাবো
এর পর আমাদের দিবসের দুটি ভিন্ন অস্তাচলেঃ
আমি রয়ে যাবো অন্তরালে, আর সে
ফিরে দখল নেবে তার পর্বতচূড়ায়।
***
আমার ধ্বংসের উপর বিম্বগুলি আহরিৎ
নেকড়েটা ঢলে পড়ে আমার ছাগলের গায়ে
আমারই মতন সেও স্বপ্ন দেখে, ফেরেশতারাও তেমনি
জীবন এখানে…ঐখানে নয়।
***
এই অবরোধের সময়ে, কাল স্থানে বদলায়
আবদ্ধ অসীমের ইন্দ্রজালে
এই অবরোধের সময়ে, স্থান কালে বদলায়
অতীত আর ভবিষ্যতহীন সময়।
***
শহীদের আত্মা আমাকে ঘিরে ধরেঃ প্রতিবার যখন আমি একটা নতুন দিনে পার করে যাই
আর আমাকে প্রশ্ন করেঃ কোথায় তুমি? অভিধানে ফিরিয়ে নাও
সব শব্দ যা আমাকে দিয়ে ছিলে
প্রতিধ্বনির কোলাহল থেকে নিদ্রিতকে মুক্তি দাও।
***

শহীদের আত্মা আমাকে আলোকিত করেঃ দিগন্তের ওপারে
আমি তাকাই নি
আমি যে ভালোবাসি জীবন, অমরত্বের সৌকুমার্য
আর এই পৃথিবীর উপর ডুমুর আর পাইনের গাছ
কিন্তু আমি তাকে ছুতে পারি না, তবু আমার শেষ সম্বলটুকু নিয়ে সেই লক্ষ্যে ছুটিঃ নীলিমার মতো প্রবাহিত শোণিতধারায়।
***
শহীদের আত্মা আমাকে সতর্ক করেঃ তাদের উচ্চকিত উচ্চারণে বিভ্রান্ত হয়ো না,
বিশ্বাস করো আমার পিতাকে, কান্নার সময়, আমার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন
কিভাবে আমরা বদলেছি চরিত্র, হে পুত্র, আমার আগে কিভাবে চলে গেলে
আমি আগে, আমিই প্রথমে।
***
শহীদের আত্মা আমাকে ঘিরে ধরেঃ আমার বাসস্থান আর অযত্নের আসবাব, যা কিছু আমি বদলেছি
বিছানায় একটা গজলা হরিণ
আঙুলের উপর রেখেছি শুক্লপক্ষের নতুন চাদঁ
বেদনার শমতাকাঙ্ক্ষায়।
***
এই অবরোধে শেষমেশ আমরাও পরিপূর্ণ স্বাধীনতায় মেনে নেবো এক উদার দাসত্ব!
***
প্রতিরোধ হলো আপনার স্বস্থ হৃদয়ের আশ্বাস
অণ্ডকোষের স্বাস্থ্য আর তোমার প্রনিধানযোগ্য ব্যাধিঃ
কামনার ব্যাধি।
***
আর যতটুকু বাকী থাকে ভোরের, আমি হেটে যাই আমার বাইরে
আর যতটুকু বাকী থাকে রাত্রির, আমি শুনি আমার ভেতরের পদধ্বনি।
***
অভিবাদন তাদের যারা আমারই মতন অপেক্ষা করে
তীব্র মদিরতাময় আলোর, প্রজাপতির পাখায়,
এই সুড়ঙ্গের অন্ধকারের ভিতর।
***
অভিবাদন তাদের যারা আমার সাথে পানপাত্র ভাগ করে
শুণ্যতাকে দ্বিধাভক্ত করে পার হওয়া ঘনীভূত রাতঃ
অভিবাদন আমার অশরীরী আত্মাকে
***
আমার বন্ধুরা সর্বদা আমার বিদায় ভোজের প্রস্তুতি নিচ্ছে
ওক গাছের ছায়ায় প্রশান্তির সমাধি
সময়ের মর্মরে রচিত এপিটাফ
আর আমিও সর্বদা তাদেরকে জানাজায় দেখতে চাই
তাহলে কে মরেছে...কে?
***
কবিতা হলো একটা কুকুরের বাচ্চা, শুণ্যতা কামড়ায়;
কবিতা হলো শোণিতহীন আঘাত।
***
আমাদের কফির পেয়ালা, পাখি আর হরিদ্বর্ণ বৃক্ষ
নীলাভ ছায়ার নীচে, গজলা হরিণের ন্যায়
খেলা করে সূর্যটা, এ দেয়াল থেকে ও দেয়ালে
মেঘের নীহারবিন্দুগুলি আছে ঠিক সেই,
অনন্ত আকাশের যতটুকু বাকী আছে আমাদের জন্য।
আর যা কিছু বাকী আছে প্রলম্বিত অনুধ্যানে
বলে দেয় - এই সকালটা কত প্রবল, অনবদ্য;
আর আমরা মহাকালের সঙ্গী।

No comments: