Tuesday, October 26, 2010

ভূতংকর হিতংকর

দেরিদা খুঁজে বের করেছিলেন, অথবা বলা যেতে পারে, দেরিদা পড়ার পর আমি খেয়াল করে দেখলাম, আসলেই কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো শুরু হয়েছে কমিউনিজমের “ভূত” দিয়ে| ধন্যবাদ দেরিদাকে আরেকটা কারণে, তা হলো শেক্সপিয়ারকে মনে করিয়ে দেবার জন্য| হ্যামলেটকে কি ভুতে ধরেছিল? প্রত্যেকটা আধুনিক মানুষকেই নাকি ভুতে ধরতে পারে, পল ভ্যালেরিরও তাই মত| আপাতত দুনিয়ার মেহনতি মানুষকে নৈতিক ধন্যবাদটুকু দিতে ভূতে ধরা লাগে না বলেই মনে হয়| দেরিদা পড়ে আমি অবাক হই| কারণ দেরিদা text এর অর্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে সামনে নিয়ে আসেন| আমার পাঠ সীমিত, তথাপি এটা বোঝা যায়, আমার (ঘাড়ে চেঁপে বসা) ভূত আমাকে সত্যি কথাটা প্রথম দিন বলে দিলেও, সেটার কার্যক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণ ও কার্যকরণের জন্য শতাব্দী পেরিয়ে যেতে পারে| আমার ভুতের সমালোচনা ছিল, সে বিপ্লব দেখতে চায়, সে স্বার্থপর, কখনো তাকে “গোলে হরিবোল” বলার দায়ও দেয়া হতো, ইংরেজিতে যাকে বলে “superficial”|

বিদেশে আমার প্রথম দিন| “বিদেশ” না বলে যদি বলি অস্ট্রেলিয়া, তাহলে অর্থে যতটুকু পার্থক্য হয়, তাতে পাঠকের সুবিধা-অসুবিধা দুইই ঘটতে পারে, তবে লেখককে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে, যদি না লেখক পাঠককে কোন বিশেষ অর্থে দ্বন্দ্ব উপহার দিতে চান, text এর অন্তর্নিহিত ambiguity সেটার জন্য দায়ী হলে তা হবে লেখকের ত্রুটি| তবে এই সকল ত্রুটি থেকে মনোযোগী পাঠক মুক্তি দিতে পারেন, সেটা আবার লেখকের পক্ষে নাও যেতে পারে| ধরে নেয়া যাক কোনো সমগোত্রীয় ভূতের প্রতি সম্বোধন করা হচ্ছে| এটি সবচেয়ে সুবিধার, কেননা “ভালো জ্বিন” “খারাপ জ্বিন” বলে ব্যাপারও থাকতে পারে|

ফিরে যাই ভূতের কথায়| প্রথম দিনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দেখি ফিদেল ক্যাস্ট্রো সেজে একজন দাড়িয়ে আছে| মুখে চুরুট আছে, আগুন জ্বলে না, ধোঁয়াও নেই| উদ্দেশ্য দৃষ্টি আকর্ষণ| সুন্দরী নারী লিফলেট বিলাচ্ছে| আমার অভিজ্ঞতায় নতুন| সুন্দরীকে জিগ্গেস করাতে বের হয়ে এলো এটি অস্ট্রেলিয়ান বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের প্রচারণার অংশ| খুশি হয়ে গেলাম| পরী আমার ইমেইল এড্রেস নিল, জেলি আরিয়েনের মিটিংয়ের সিডিউল ধরিয়ে দিল| আরিয়েনকে ফেসবুকে খুঁজে পেলাম, ইনি ইন্দোনেশিয়ার কর্মী|

আরিয়েনের মিটিং টাতে যেতে পারলাম না| কয়েকদিন পর পেলাম আরেকটা দাওয়াত, ইমেইল মারফত| কলম্বিয়ার গেরিলাদের উপর চলচিত্র দেখার| আমি তখন পুরোদমে সিনেমা দেখে সময় কাটাই| The man with the movie camera দেখার ব্যর্থ চেষ্টাও হয়ে গেছে কয়েকবার| ভাবলাম সিনেমা দেখার সুযোগটা অন্তত নেয়া যাক| শনিবার ঠিক ঠিক ট্রেনে করে পার্টি অফিস খুঁজে বের করে চলে গেলাম| গিয়ে দেখি আরম্ভও হয়ে গেছে| বনের ভিতর গেরিলাদের ক্যাম্প| অনেকটা অরুন্ধতীর ভারতীয় মাওবাদীদের বর্ণনার সাথে মিলে যায়|

গেরিলারা স্বতস্ফুর্তভাবে যোগ দিচ্ছে, তাদের হাতে বিষম আকৃতির আগ্নেয়াস্ত্র, ট্রেনিং হচ্ছে, বিজ্ঞান, সমাজবিদ্যাসহ অন্যান্য বিষয়েও, কি কি শেখানো হতে পারে সে বিষয়েও যুক্তি, তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বলা হচ্ছে| কয়েকদিন আগেই মাত্র তামিল নিধন হয়ে গেল, শ্রীলংকাতে| এদের প্রধানের চেহারাটা দেখে প্রভাকরণের কথা মনে হলো| আমি ছাড়া বাকি সবাই বেশ পরিণত বয়স্ক| লোক কমই, ৬-৭ জন শ্রোতা ও দর্শক| একজন আবার বাইরে গিয়ে বিয়ার আর সিগারেট চালাচ্ছিল|

একটা ছোট ঘর, কমিউনিস্টদের আস্তানা যেমন হয়: বইয়ের সেল্ফ, দশ-বারোটা চেয়ার, দেয়ালে পোস্টার সাঁটা হরেক রকমের, একটা আবার abortion এর উপর| স্যুপের গন্ধ আসছে রানা ঘর থেকে,একজন জিগ্গেস করলো আমি কোনো ড্রিঙ্কস চাই কিনা, বা রাতে খাব কি না| খাব না, কারণ পকেটে পাঁচ টাকা নিয়ে এসেছিলাম, তাকে চাঁদা হিসেবে দিয়ে দিলাম, ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে লজ্জাই লাগছিল, কিন্তু ওর বেশি তখন আর দেই কি করে?

একটা মেয়ে বলছিল, কেন ক্যাম্পে সন্তান-ধারণ নিষিদ্ধ, কারণ যুদ্ধাবস্থায় শিশু লালন-পালন বা গর্ভাবস্থা কোনটাই আসলে সুবিধার না, দলের জন্যও না, ব্যক্তির জন্যও না| সুরটা ভালো লাগলো না| কারণ কোনো মেয়ে প্রেগনেন্ট হয়ে গেলে তাকে দলত্যাগ করতে হবে, তার পার্টনার সম্বন্ধে কিছুই বলা হলো না|সিনেমা দেখার মোহ কেটে গেল, তথ্যের প্রতি মোহ কাটতেও সময় লাগলো না| উঠে বের হয়ে গেলাম| শীতের রাত| ট্রেনে করে বাড়ি ফিরতে সময় লাগলো না|

ভাবনার বিষয়: abortion কোন অবস্থাতে সমর্থনযোগ্য? অপরাধতত্ত্বেও নাকি গর্ভপাতের আইনের প্রভাব থাকতে পারে| অস্ট্রেলিয়ার বিপ্লবীদের শ্লোগান হিসেবে যে এটি উঠে এসেছে তা টের পেলাম পরের কিছু মেইলে| তারা অস্ট্রেলিয়াতেও abortion বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে| ভূত টা সঙ্গেই থাক কিছু দিন| দেখা যাক, গর্ভপাত বিষয়ে বাকি ভূতেরা কি বলে| উল্লেখ্য বাংলাদেশের সরকারের আইনে, সম্ভবত এক মা কে বাঁচানোর কেস ছাড়া সব ক্ষেত্রে গর্ভপাত দন্ডনীয়। ধর্মগুলি এর বিরুদ্ধে| কিন্তু আম্রিকা ও কিছু সেক্যুলার রাষ্ট্র(ফ্রান্স) গর্ভপাতের পক্ষে আইন করেছে, এটাও একটা অধিকার(!) | সেই সাথে আছে নানা মারপ্যাচ, ১২ সপ্তাহ, ১৮ সপ্তাহ ইত্যাদি, ইত্যাদি|